১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার প্রকৃতি

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার,আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।এতে ৩০ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই গণহত্যা নিয়ে পরবর্তীকালে অপপ্রচার করা হয়েছে। পাকিস্তানিরাই সর্বপ্রথম এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে। তাদের বক্তব্য বাংলাদেশ ৩০ লক্ষ শহীদ হয়নি। তিন লক্ষ ও না।ডেভিড ফ্রস্টের সাথে আলোচনাকালে শেখ মুজিব ৩ লক্ষকে ভুল ইংরেজিতে থ্রি মিলিয়ন বলেছিলেন।আসলে বঙ্গবন্ধু তখন স্বীকৃত সংখ্যাটি বলেছিলেন। মস্কো থেকে প্রকাশিত প্রভদা পত্রিকার প্রথম ৩০ লক্ষ সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়।বাস্তবে এ সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি।
৭১ এর গণহত্যার বর্ননা
গণহত্যা শুরু ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ। স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট  নামে গণহত্যা শুরু হয়। এ সময় মহা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। রাজার বাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০ জন শিক্ষক ও ৩০০(প্রায়) জন ছাত্র এবং ঢাকা শহরের ৮ হাজারের মতো সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য ঢাকা শহরে ব্যাপক হারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও অন্যান্য গ্যারিসন শহরগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়। ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ২৮ মার্চ দৈনিক টেলিগ্রাফ(লন্ডন) পত্রিকায় রিপোর্ট করে ২৮ শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে অন্তত ১৫ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন অধ্যাপক এবং ২০০ জন ছাত্রকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। অন্য রিপোর্ট থেকে জানা যায় হত্যাকান্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০ হাজার নর-নারীকে হত্যা করা হয়। ঢাকায় প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

 এভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে চালানো হয় গণহত্যা। গণহত্যা চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে অনেক মানুষকে একসাথে পুঁতে রাখা হয়, ঐ সমস্ত স্থান পরবর্তীকালে গনকবর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে, স্থানগুলো বধ্যভূমি নামে চিহ্নিত হয়েছে।যেমন রায়েরবাজার বধ্যভূমি। বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানে গনকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে।বধ্যভূমি ও গণকবর সংখ্যা এক হাজারের অধিক। দেশের সবচেয়ে বেশি লোককে হত্যা করা হয়েছিল খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত চুকনগড়ে,যেটি ইতিহাসের চুকনগড় গণহত্যা নামে পরিচিত। এখানে ১০ হাজারের অধিক লোককে হত্যা করা হয়েছিল।
বর্বরতার খন্ড চিত্র
গণহত্যার পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনারা এদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা:

নোওয়াখালি: ৭১ হাজার
নওগাঁ:৫০ হাজার
জামালপুর:৭৫ হাজার
বগুড়া :৮০ হাজার
নরসিংদী :৯০%
শান্তাহার :৫ হাজার
টাঙ্গাইল:২১,৩৪৮
গনরহত্যার খন্ড চিত্র
বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য বাড়িঘরের মত টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। বাড়িঘরের পাশাপাশি স্কুল ঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসযজ্ঞের নিম্নরূপ চিত্র পাওয়া যায়:

কুমিল্লা :১৪৬০
সাতক্ষিরা :৭৫%
নওগাঁ:৩০ হাজার
সিরাজগঞ্জ :৮০%
গনকবরের চিত্র
চট্টগ্রামের মাধ্যমিক স্কুল গুলোর ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৫ কোটি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ২২ লক্ষ। মোট ৩৪৫৭ টি  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছিল যার ক্ষতির পরিমাণ 135 কোটি টাকা এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা হল:

বিআইডিসি:১০ কোটি
শিল্পপ্রতিষ্ঠান:১৫০ কোটি
বাস:১০০০টি
সেতু:২৭৪টি
কৃষিপণ্য :৩৯৪ কোটি
ডিআইটি:২ লাখ
ইমরাত বিভাগ:৩ কোটি

 দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওইসব প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ:

রামগড় :৫ কোটি
ভৈরব শহর :১০০ কোটি
ভৈরব বন্দর: ৩০০ কোটি
রাজশাহী: ৫ কোটি
জামালপুর: ১২ কোটি
চালনা বন্দর: ১.৫০ কোটি
বধ্যভূমির চিত্র
মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছিল এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।১৯৭২ সালে প্রকাশিত কয়েকটি অঞ্চলে প্রতিবেদন দেখলেই গা শিউরে ওঠে:

দিনাজপুর:৭৫ হাজার
চাঁদপুর :১০ হাজার
বরিশাল শহর:২৫ হাজার
ঝালকাঠি:১০ হাজার
রংপুর :৬০ হাজার
আখাউড়া :২০ হাজার
ঠাকুরগাঁ :৩০ হাজার
চট্টগ্রাম :১ লক্ষের উপরে
সেতাবগঞ্জ :৭ হাজার
পার্বতীপুর:১০ হাজার
সৈয়দপুর:১০ হাজার
কুড়িগ্রাম :১০ হাজার
কুষ্টিয়া :৪০ হাজার
নওগাঁ :২০ হাজার
কুমিল্লা:২০ হাজার
নড়াইল :১০ হাজার
বগুড়া শহর:২৫ হাজার
জামালপুর:১০ হাজার
চৌদ্দগ্রাম থানা:১ হাজার
স্বরূপকাঠি ও বানারীপাড়া:৫ হাজার
মানিকগঞ্জ :১ হাজার
নরসিংদী:১০১৯
হাজিগঞ্জ:৩০ হাজার

 হরিরামপুরের একটি পুকুরে পাওয়া গিয়েছিল ১০ হাজার নরমুণ্ডু।কুমিল্লায় ১১ দিনে উদ্ধার করা হয়েছিল ৫০০। জয়পুরহাটে একদিনে উদ্ধার করা হয়েছিল ৫০০ এর বেশি। দিনাজপুরের দুটি গ্রামে ৩৭ হাজার। শেরপুর জেটিতে ২০০০। যারা খবর আনানেওয়া করতেন তাদের মধ্যে ১৫০ জনকে বাঘের খাচায় ভরে  বাঘ দিয়ে খাওয়ানো হয়। হানাদার বাহিনীর মাইন বিস্ফোরণের কারণে মারা যায় ৯৬ জন।

 সুতরাং আমরা বলতে পারি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। মানবসভ্যতার সকল নিয়ম লংঘন করে তারা দেশে গণহত্যা চালায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের সময় যেভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের উপর চালানো পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা সকল বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার জন্য ধিক্কার বৈ আর কিছুই পাবে না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url