নেকলেস লেখক গী দ্য মোপাসাঁ অনুবাদ:পূর্ণেন্দু দস্তিদার পর্ব-২
নেকলেস লেখক গী দ্য মোপাসাঁ |
তোমার হয়েছে কি? গত দু-তিন দিন ধরে তোমার কাজকর্ম কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে।'
শুনে মেয়েটি জবাব দেয়, 'আমার কোন মনি মুক্তা, একটি দামী পাথর কিছুই নেই যা দিয়ে আমি নিজেকে সাজাতে পারি। আমায় দেখলে কেমন গরিব গরিব মনে হবে।তাই এই অনুষ্ঠানে আমার না যাওয়াই ভালো হবে।
স্বামী বলল,' কিছু সত্যকার ফুল দিয়ে তুমি সাজতে পারো। এই ঋতুতে তাতে বেশ সুরুচিপূর্ণ দেখায়। দশ ফ্রাঁ দিলে তুমি দুটি তিনটি অত্যন্ত চমৎকার গোলাপ ফুল পাবে।
মেয়েটির কথায় আশ্বস্ত হলো না। সে জবাবে বলল,' না, ধনী মেয়েদের মাঝখানের পোশাক-পরিচ্ছদে ঐরকম খেলো দেখানোর মত আর বেশি কিছু অপমানজনক নেই।'
তখন তার স্বামী চেঁচিয়ে উঠলো:' আচ্ছা, কি বোকা দেখতো আমরা! যাও তোমার বান্ধবী মাদার ফোরসটিয়ারের সঙ্গে দেখা করে তাকে বল তার জড়োয়া গহনা তোমায় ধার দেয়। এটুকু আদায় করার তো তার সঙ্গে তেমন পরিচয় যথেষ্ট।'
The Necklace - Guy De Maupassant |
সত্যিই তো! এটা আমি ভাবিনি।'
পরদিন সে তার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে তার দুঃখের কাহিনী তাকে বলল।মাদাম ফোরনটিয়ার তার কাচের দরজা লাগানো গোপন কক্ষে গিয়ে বড় একটি জড়োয়া গহনার বাক্স বের করে এনে তা খুলে বলল:
'ভাই, যা ইচ্ছা এখান থেকে নাও।'
সে প্রথমে দেখলো কয়েকটি কঙ্কন, তারপর একটি মুক্তার মালা ও মনি মুক্তা -খচিত চমৎকার কারুকার্য করা একটি সোনার ভিনিশার 'ক্রুষ'। আয়নার সামনে গিয়ে সে জড়োয়া গহনা গুলি পড়ে পড়ে দেখে আর ইতস্তত করে, কিন্তু ওগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত করতেও ছেড়ে যেতেও পারে না।তারপর সে জিজ্ঞাসা করে:
আর কিছু তোমার নেই?
কেন? আছে, তোমার যা পছন্দ তুমি বেছে নাও।'
হঠাৎ সে কালো স্যাটিনের একটি বাক্সে দেখল অপরূপ একখানা হীরার হার। অদম্য কামনায় তার বুক দূর দূর করে। সেটা তুলে নিতে গিয়ে তার হাত কাঁপে। সে তার পোশাকের উপর দিয়ে সেটা গলায় তুলে নেয় এবং সেগুলো দেখে আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায়। তারপর উদ্বেগ ভরা, ইতস্ততভাবে সে জিজ্ঞাসা করল:
' তুমি ওইখানা আমায় ধার দেবে? শুধু এটা?'
'কেন দেব না? নিশ্চয়ই দেব।'
সে সবেগে গিয়ে তার বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ধরে, পরম আবেগে তাকে বুকে চেপে ধরে। তারপর তার সম্পদ নিয়ে এসে চলে আসে।
'বল' নাচের দিন এসে গেল।মাদাম লোইলেসের জয়জয়কার। সে ছিল সবচেয়ে সুন্দরী,সুরুচিময়ী, সুদর্শনা, হাস্যময়ী ও আনন্দপূর্ণ। সব পুরুষ তাকে লক্ষ্য করছিল, তার নাম জিজ্ঞাসা করে তার সঙ্গে আলাপের আগ্রহ প্রকাশ করছিল। মন্ত্রিসভার সব সদস্যের তার সঙ্গে'ওয়ালটজ' মৃত্যু করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। স্বয়ং শিক্ষা মন্ত্রী তার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলেন।
The Necklace |
ভোর চারটার দিকে সে বাড়ি ফিরে গেল। অন্য সেই তিনজন ভদ্রলোকের স্ত্রী খুব বেশি ফুর্তিতে মত্ত ছিল, তাদের সঙ্গে তার স্বামী চরিত্রে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত আধঘুমে বসেছিল।
বাড়ি ফিরবার পথে গায়ে জড়াবার জন্য তার যে আটপৌরে সাধারণ চাদর নিয়ে এসেছিল সে তার কাঁধের উপর সেটি ছড়িয়ে দেয়।'বল' নাচের পোশাকে অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে ওয়েটিং দারিদ্র সুপরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। মেয়েটির তা অনুভব করতে পারে তাই অন্য যেসব ধনীর মেয়ের দামী পশমী চাদর দিয়ে ঢেকে ছিল তাদের চোখে না পড়বার জন্য সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল।
লোইসেল তাকে টেনে ধরে বলল:'থামো, তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে ওখানে। আমি খানা গাড়ি ডেকে আনি।'
কিন্তু মেয়েটি কোন কথায় কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। রাস্তায় যখন তারা পৌঁছে গেল, সেখানে কোন গাড়ি পাওয়া গেল না। তারা গাড়ির খোঁজ করতে করতে দূরে কোন এখানে দেখে তার গাড়োয়ানকে ডাকতে থাকে।
হতাশ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা সিন নদীর দিকে হাঁটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত যে পুরাতন একখানা তারা পায়,তাহলো সেই নিশাচর দুই যাত্রীর গাড়ি যা প্যারিসে সন্ধ্যার পর লোকের চোখে পড়ে, তার একখানা, যেইদিনে এইগুলি নিজের দুর্দশা দেখাতে লজ্জা পায়।
ওইখানে তাদের মার্টার স্ট্রিটে ঘরের দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারা ক্লান্তভাবে তাদের কক্ষে গেল। মেয়েটির সব কাজ শেষ। কিন্তু স্বামীর ব্যাপারে, তার মনে পড়ল যে দশটায় তাকে অাফিসে গিয়ে পৌঁছাতে হবে।
কিন্তু গৌরবমন্ডিত রূপে শেষ একবার দেখার জন্য সে আয়নার সামনে গিয়ে তার গলার চাদর খানা খুলে।হঠাৎ সে আর্তনাদ করে উঠল। তার হার খানা গলায় জড়ানো নেই।
তার স্বামীর পোশাক তখন অর্ধেক মাত্র খোলা হয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করলো :কি হয়েছে?
উত্তেজিতভাবে মেয়েটি তার দিকে ফিরে বলল আমার -আমার কাছে মাদাম ফ্রস্টিয়ারের হার খানা নেই।
স্বামী জিজ্ঞেস করলো :'ওই বাড়ি থেকে চলে আসবার সময় কাজে তোমার গলায় ছিল, তোমার ঠিক মনে আছে?
হ্যাঁ আমরা যখন বিশ্রাম কক্ষ দিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম তখন তা ছিল আমার খেয়াল আছে।
কিন্তু তুমি যদি ওটা রাস্তায় হারাতে ওটা পরবার শব্দ আমাদের শোনা উচিত ছিল। গাড়ির মধ্যেই নিশ্চয়ই পড়েছে মনে হয়।
হ্যাঁ সম্ভবত তাই তুমি গাড়ির নম্বর টি টুকে নিয়েছিলে?
না।
আর তুমি কি তা লক্ষ করেছিলে?
না।
সে বলল আমি যাচ্ছি দেখি যতটা রাস্তা আমরা হেঁটে ছিলাম সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
তারপর সে গেল। মেয়েটি তার সন্ধ্য গাউন পরেই রয়ে গেল। বিছানাতে শুয়ে যাবার শক্তি তার নেই। কোনো উচ্চাশা বা ভাবনা ছাড়াই সেখানে চেয়ারে গা এলিয়ে পড়ে রইল।
সকাল সাতটার দিকে তার স্বামী ফিরে এলো। কিছুই সে খুঁজে পায়নি।