ভ্রমনকাহিনী: পালামৌ - সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বহুকাল হইল আমি একবার পালামৌ প্রদেশে গিয়াছিলাম, প্রত্যাগমন করিলে পর সেই অঞ্চলের বৃত্তান্ত লিখিবার নিমিত্ত দুই-এক জন বন্ধুবান্ধব আমাকে পুনঃপুন অনুরােধ করিতেন, আমি তখন তাহাদের উপহাস করিতাম। এক্ষণে আমায় কেহ অনুরােধ করে না, অথচ আমি সেই বৃত্তান্ত লিখিতে বসিয়াছি। গল্প করা এ বয়সের রােগ, কেহ শুনুন বা না-শুনুন, বৃদ্ধ গল্প করে।
অনেক দিনের কথা লিখিতে বসিয়াছি, সকল স্মরণ হয় না। পূর্বে লিখিলে যাহা লিখিতাম, এক্ষণে যে তাহাই লিখিতেছি এমত নহে। পূর্বে সেই সকল নির্জন পর্বত, কুসুমিত কানন প্রভৃতি যে-চক্ষে দেখিয়াছিলাম, সে চক্ষু আর নাই। এখন পর্বত কেবল প্রস্তরময়, বন কেবল কণ্টকাকীর্ণ, অধিবাসীরা কেবল কদাচারী বলিয়া স্মরণ হয়।
যখন পালামৌ আমার যাওয়া একান্ত স্থির হইল, তখন ইল্যান্ড ট্রাঞ্জিট কোম্পানির ডাকগাড়ি ভাড়া করিয়া
রাত্রি দেড় প্রহরের সময় রানিগঞ্জ হইতে যাত্রা করিলাম। প্রাতে বরাকর নদীর পূর্বপারে গাড়ি থামিল । নদী অতি ক্ষুদ্র, তৎকালে অল্পমাত্র জল ছিল, সকলেই হাঁটিয়া পার হইতেছে, গাড়ি ঠেলিয়া পার করিতে হইবে, অতএব গাড়ওয়ান কুলি ডাকিতে গেল।
এমত সময় কুলিদের কতকগুলি বালক বালিকা আসিয়া আমার গাড়ি ঘেরিল। সাহেব একটি পয়সা, সাহেব একটি পয়সা।' এই বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল।
তাহাদের সঙ্গে একটি দুই বৎসর বয়স্ক শিশুও আসিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল।কেন হাত পাতিল তাহা সে জানে না, সকলে হাত পাতিয়াছে দেখিয়া সেও হাত পাতিল। আমি তাহার হস্তে একটি পয়সা দিলাম, শিশু তাহা ফেলিয়া দিয়া আবার হাত পাতিল, অন্য বালক সে পয়সা কুড়াইয়া লইলে শিশুর ভগিনীর সহিত তাহার তুমুল কলহ বাধিল। এই সময় আমার গাড়ি অপর পারে গিয়া উঠিল।
বরাকর হইতে দুই-একটি ক্ষুদ্র পাহাড় দেখা যায়। বঙ্গবাসীদের কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্থূপ দেখিলেই তাহাদের আনন্দ হয়। অতএব সেই ক্ষুদ্র পাহাড়গুলি দেখিয়া-যে তৎকালে আমার যথেষ্ট আনন্দ হইবে ইহা আর আশ্চর্য কী ?
অপরাহ্লাে দেখিলাম একটি সুন্দর পর্বতের নিকট দিয়া গাড়ি যাইতেছে। এত নিকট দিয়া যাইতেছে যে,পর্বতস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাইতেছে। গাড়ওয়ানকে গাড়ি থামাইতে বলিয়া আমি নামিলাম ।
গাড়ওয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাইবেন ? আমি বলিলাম, একবার এই পর্বতে যাইব।' সে হাসিয়া বলিল, পাহাড় এখান হইতে অনেক দূর, আপনি সন্ধ্যার মধ্যে তথায় পৌঁছিতে পারিবেন না। আমি এ-কথা কোনােরূপে বিশ্বাস করিলাম না। আমি স্পষ্ট দেখিতেছিলাম, পাহাড় অতি নিকট, তথা যাইতে আমার পাঁচ মিনিটও লাগিবে না, অতএব গাড়ওয়ানের নিষেধ না-শুনিয়া আমি পর্বতাভিমুখে চলিলাম। পাঁচ মিনিটের
স্থলে ১৫ মিনিটকাল দ্রুতপদবিক্ষেপে গেলাম, তথাপি পর্বত পূর্বমতাে সেই পাঁচ মিনিটের পথ বলিয়া বােধ হইতে লাগিল। তখন আমার ভ্রম বুঝিতে পারিয়া গাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম। পর্বত সম্বন্ধে দূরতা স্থির করা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় কঠিন, ইহার প্রমাণ পালামৌ গিয়া আমি পুনঃপুন পাইয়াছিলাম ।
পরদিবস প্রায় দুই প্রহরের সময় হাজারিবাগ পৌঁছিলাম।তথায় গিয়া শুনিলাম, কোনাে সম্রান্ত বঙ্গবাসীর বাটীতে আমার আহারের আয়ােজন হইতেছে।
যে বঙ্গবাসীর গৃহে আতিথ্য স্বীকার করিতে যাইতেছিলাম, তথায় গিয়া গাড়ি থামিলে আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। আমাকে দেখিয়া তাঁহারা সকলেই সাদরে অগ্রসর হইলেন। না চিনিয়া যাহার অভিবাদন আমি সর্বাগ্রে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তিনিই বাটীর কর্তা। সেখানে তিন শত লােক থাকিলেও আমার দৃষ্টি বােধহয় প্রথমেই তাঁহার মুখের প্রতি পড়িত। সেরূপ প্রসন্নতাব্যঞ্জক ওষ্ঠ আমি অতি অল্প দেখিয়াছি। তখন তাহার বয়ঃক্রম বােধহয় পঞ্চাশ অতীত হইয়াছিল, বৃদ্ধের তালিকায় তাহার নাম উঠিয়াছিল, তথাপি তাহাকে বড় সুন্দর দেখিয়াছিলাম। বােধহয় সেই প্রথম আমি বৃদ্ধকে সুন্দর দেখি।
যে সময়ের কথা বলিতেছি, আমি তখন নিজে যুবা; অতএব সে বয়সে বৃদ্ধকে সুন্দর দেখা ধর্মসঙ্গত নহে।
কিন্তু সে দিবস এরূপ ধর্মবিরুদ্ধ কার্য ঘটিয়াছিল এক্ষণে আমি নিজে বৃদ্ধ, কাজেই প্রায় বৃদ্ধকে সুন্দর দেখি।একজন মহানুভব বলিয়াছিল যে, মনুষ্য বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।
আহারান্তে বিশ্রামগৃহে বসিয়া বালকদিগের সহিত গল্প করিতে করিতে বালকদের শয়নঘর দেখিতে উঠিয়া
গেলাম। ঘরটি বিলক্ষণ পরিসর, তাহার চারি কোণে চারিখানি খাট পাতা, মধ্যস্থলে আর-একখানি খাট
রহিয়াছে। জিজ্ঞাসা করায় বালকেরা বলিল, ‘চারি কোণে আমরা চারিজন শয়ন করি, আর মধ্যস্থলে মাস্টার মহাশয় থাকেন। এই বন্দোবস্ত দেখিয়া বড় পরিতৃপ্ত হইলাম। দিবারাত্র ছাত্রদের কাছে শিক্ষক থাকার আবশ্যকতা অনেকে বুঝেন না।
বালকদের শয়নঘর হইতে বহির্গত হইয়া আর-একঘরে দেখি, এক কাঁদি সুপক্ক মর্তমান রম্ভা দোদুল্যমান
রহিয়াছে, তাহাতে একখানি কাগজ ঝুলিতেছে। পড়িয়া দেখিলাম, নিত্য যত কদলী কাদি হইতে ব্যয় হয়,তাহাই তাহাতে লিখিত হইয়া থাকে ! লােকে সচরাচর ইহাকে ক্ষুদ্র দৃষ্টি, ছােটনজর ইত্যাদি বলে :কিন্তু আমি তাহা কোনােরূপে ভাবিতে পারিলাম না। যেরূপ অন্যান্য বিষয়ের বন্দোবস্ত দেখিলাম, তাহাতে কলাকাদির
হিসাব’ দেখিয়া বরং আরাে চমকৃত হইলাম। যাহাদের দৃষ্টি ক্ষুদ্র তাহারা কেবল সামান্য বিষয়ের প্রতিই দৃষ্টি
রাখে, অন্য বিষয় দেখিতে পায় না। কিন্তু আমি যাহার কথা বলিতেছি, দেখিলাম তাঁহার নিকট বৃহৎ সূক্ষ্ম
সকলই সমভাবে পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। অনেকে আছেন, বড় বড় বিষয় মােটামুটি দেখিতে পারেন, কিন্তু
সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি তাঁহাদের দৃষ্টি একেবারে পড়ে না। তাহাদের প্রশংসা করি না। যাঁহারা বৃহৎ সূক্ষ্ম একত্র
দেখিয়া কার্য করেন, তাঁহাদেরই প্রশংসা করি।
আমি ভাবিয়াছিলাম পালামৌ প্রবল শহর, সুখের স্থান। তখন জানিতাম না যে পালামৌ শহর নহে, একটি প্রকাণ্ড পরগনামাত্র। শহর সে অঞ্চলেই নাই, নগর দূরে থাকুক, তথায় একখানি গণ্ডগ্রামও নাই, কেবল পাহাড়
ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
রাচি হইতে পালামৌ যাইতে যাইতে যখন বাহকগণের নির্দেশমতাে দূর হইতে পালামৌ দেখিতে পাইলাম,তখন আমার বােধ হইল যেন মর্তে মেঘ করিয়াছে। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া সেই মনােহর দৃশ্য দেখিতে লাগিলাম। এ অন্ধকার মেঘমধ্যে এখনই যাইব এই মনে করিয়া আমার কতই আহ্লাদ হইতে লাগিল।কতক্ষণে পৌছিব মনে করিয়া আবার কতই ব্যস্ত হইলাম।
পালামৌ প্রবেশ করিয়া দেখিলাম নদী, গ্রাম সকলই আছে, দুর হইতে তাহা কিছুই দেখা যায় নাই। পালামৌ
পরগনায় পাহাড় অসংখ্য, পাহাড়ের পর পাহাড়, তাহার পর পাহাড়, আবার পাহাড়;যেন বিচলিত নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গ।
সেখানে একবার একটি পাহাড় দেখিয়া চমকৃত হইয়াছিলাম। সেটি একশিলা, সমুদয়ে একখানি প্রস্তর। তাহাতে একেবারে কোথাও কণামাত্র মৃত্তিকা নাই, সমুদয় পরিষ্কার ঝরঝর করিতেছে। তাহার একস্থান অনেক দূর পর্যন্ত ফাটিয়া গিয়াছে, সেই ফাটার উপর বৃহৎ এক অশ্বথগাছ জন্মিয়াছে। তখন মনে হইয়াছিল, অশ্বথবৃক্ষ বড় রসিক,এই নীরস পাষাণ হইতেও রসগ্রহণ করিতেছে। কিছুকাল পরে আর একদিন এই অশ্বথগাছ আমার মনে।পড়িয়াছিল, তখন ভাবিয়াছিলাম বৃক্ষটি বড় শােষক, ইহার নিকট নীরস পাষাণেরও নিস্তার নাই।
অপরাহে পালামৌয়ে প্রবেশ করিয়া উভয়পার্শ্বস্থ পর্বতশ্রেণি দেখিতে দেখিতে বনমধ্য দিয়া যাইতে লাগিলাম।বন বর্ণনায় যেরূপ ‘শাল তাল তমাল, হিন্তাল’ শুনিয়াছিলাম, সেরূপ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তা, হিন্তাল একেবারেই নাই, কেবল শালবন, অন্য বন্য গাছও আছে। শালের মধ্যে প্রকাণ্ড গাছ একটিও নাই,
সকলগুলিই আমাদের দেশি কদম্ববৃক্ষের মতাে, নাহয় কিছু বড়; কিন্তু তাহা হইলেও জঙ্গল অতি দুর্গম,
কোথায়ও তাহার ছেদ নাই, এইজন্য ভয়ানক। এইরূপ বন দিয়া যাইতে যাইতে এক স্থানে হঠাৎ কাষ্ঠঘণ্টার
বিস্ময়কর শব্দ কর্ণগােচর হইল, কাষ্ঠঘণ্টা পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে দেখিয়াছিলাম। গৃহপালিত পশু বনে পথ হারাইলে, শব্দানুসরণ করিয়া তাহাদের অনুসন্ধান করিতে হয়, এইজন্য গলঘণ্টার উৎপত্তি। কাষ্ঠঘণ্টার শব্দ শুনিলে প্রাণের ভিতর কেমন করে। পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে সে শব্দে আরাে যেন অবসন্ন করে; কিন্তু সকলকে করে কি না, তাহা বলিতে পারি না।
অল্প বিলম্বেই অর্ধশুষ্ক তৃণাবৃত একটি ক্ষুদ্র প্রান্তর দেখা গেল, এখানে সেখানে দুই-একটি মধু বা মৌয়াবৃক্ষ
ভিন্ন সে-প্রান্তরে গুল্ম কি লতা কিছুই নাই, সর্বত্র অতি পরিষ্কার । পর্বতছায়ায় সে-প্রান্তর আরাে রম্য হইয়াছে;
তথায় কতকগুলি কোলবালক একত্র মহিষ চরাইতেছিল, সেরূপ কৃষ্ণবর্ণ কান্তি আর কখনাে দেখি নাই;সকলের গলায় পুঁতির সাতনরী, ধুকধুকির পরিবর্তে এক-একখানি গােল আরশি; পরিধানে ধড়া, কর্ণে
বনফুল; কেহ মহিষপৃষ্ঠে শয়ন করিয়া আছে, কেহবা মহিষপুষ্ঠে বসিয়া আছে, কেহ কেহ নৃত্য করিতেছে।
যেরূপ স্থান তাহাতে এই পাথুরে ছেলেগুলি উপযােগী বলিয়া বিশেষ সুন্দর দেখাইতেছিল; চারিদিকে কালাে
পাথর, পশুও পাথুরে; তাহাদের রাখালও সেইরূপ ।
এই অঞ্চলে প্রধানত কোলের বাস। কোলেরা বন্য জাতি, খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ; দেখিতে কুৎসিত কি রূপবান
তাহা আমি মীমাংসা করিতে পারি না! যে-সকল কোল কলিকাতা আইসে বা চা-বাগানে যায় তাহাদের মধ্যে
আমি কাহাকেও রূপবান দেখি নাই; বরং অতি কুৎসিত বলিয়া বােধ করিয়াছি। কিন্তু স্বদেশে কোলমাত্রেই।
রূপবান, অন্তত আমার চক্ষে। বন্যেরা বনে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
প্রান্তরের পর এক ক্ষুদ্র গ্রাম, তাহার নাম স্মরণ নাই; তথায় ত্রিশ-বত্রিশটি গৃহস্থ বাস করে। সকলেরই
পর্ণকটির। আমার পালকি দেখিতে যাবতীয় স্ত্রীলােক ছুটিয়া আসিল। সকলেই আবলুসের মতাে কালাে,
সকলেই যুবতী, সকলের কটিদেশে একখানি করিয়া ক্ষুদ্র কাপড় জড়ানাে। কর্ণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বনফুল, মাথায় বড় বড় বনফুল । যুবতীরা পরস্পর কাঁধ ধরাধরি করিয়া দেখিতে লাগিল।
বাঙ্গালার পথেঘাটে বদ্ধাই অধিক দেখা যায়, কিন্তু পালামৌ অঞ্চলে যুবতীই অধিক দেখা যায়। কোলের মধ্যে বৃদ্ধা অতি অল্প, তাহারা অধিকবয়সী হইলেও যুবতাহ থাকে, অশীতিপরায়ণা না হইলে তাহারা লােলচর্মা হয় না। অতিশয় পরিশ্রমী বলিয়া গৃহকার্য কৃষিকার্য সকল কার্যই তাহারা করে। পুরুষেরা স্ত্রীলােকের ন্যায় কেবল বসিয়া সন্তান রক্ষা করে, কখনাে কখনাে চাটাই বুনে। আলস্য জন্য পুরুষেরা বঙ্গমহিলাদের ন্যায় শীঘ্র বৃদ্ধ হইয়া যায়, স্ত্রীলােকেরা শ্ৰমহেতু চিরযৌবনা থাকে। লােকে বলে পশুপক্ষীর মধ্যে পুরুষজাতিই বলিষ্ঠ ও সুন্দর; মনুষ্যমধ্যেও সেই নিয়ম। কিন্তু কোলদের দেখিলে তাহা বােধহয় না, তাহাদের স্ত্রীজাতিরাই বলিষ্ঠ ও আর্য কান্তিবিশিষ্টা। কিন্তু তাহাদের বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষদের গায়ে খড়ি উঠিতেছে, চক্ষে মাছি উড়িতেছে, মুখে হাসি নাই, যেন সকলেরই জীবনীশক্তি কমিয়া আসিয়াছে।
একদিনের কথা বলি। যেরূপ নিত্য অপরাত্নে এই পাহাড়ে যাইতাম সেইরূপ আর একদিন যাইতেছিলাম, পথে দেখি একটি যুবা বীরদর্পে পাহাড়ের দিকে যাইতেছে, পণ্ডাতে কতকগুলি স্ত্রীলােক তাহাকে সাধিতে সাধিতে সঙ্গে যাইতেছে।
যখন আমি নিকটবর্তী হইলাম তখন স্ত্রীলােকেরা নিরস্ত হইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইল। বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করায় যুবা।
সদর্পে বলিল, আমি বাঘ মারিতে যাইতেছি, এই মাত্র আমার গােরুকে বাঘে মারিয়াছে। আমি ব্রাহ্মণ-সন্তান;
সে বাঘ না মারিয়া কোন মুখে আর জল গ্রহণ করি ? আমি কিঞ্চিত অপ্রতিভ হইয়া বলিলাম, “চল, আমি
তােমার সঙ্গে যাইতেছি।'
আমি স্বভাবত বড় ভীত, তাহা বলিয়া ব্যাঘ্র-ভল্লুক সম্বন্ধে আমার কখনাে ভয় হয় নাই। বৃদ্ধ শিকারিরা কতদিন পাহাড়ে একাকী যাইতে আমায় নিষেধ করিয়াছে, কিন্তু আমি তাহা কখনাে গ্রাহ্য করি নাই,নিত্য একাকী যাইতাম, বাঘ আসিবে, আমায় ধরিবে, আমায় খাইবে, এ সকল কথা কখনাে আমার মনে আসিত না। কেন আসিত না তাহা আমি এখনাে বুঝিতে পারি না। সৈনিক পুরুষদের মধ্যে অনেকে আপনার ছায়া দেখিয়া ভয় পায়,অথচ অম্লান বদনে রণক্ষেত্রে গিয়া রণ করে। গুলি কি তরবারি তাহার অঙ্গে প্রবিষ্ট হইবে এ-কথা তাহাদের মনে আইসে না। যতদিন তাহাদের মনে এ কথা না আইসে, ততদিন লােকের নিকট তাহারা সাহসী; যে বিপদ না বুঝে সেই সাহসী। আদিম অবস্থায় সকল পুরুষই সাহসী ছিল, তাহাদের তখন ফলাফল জ্ঞান হয় নাই।
দেখা যায় সকলেই সাহসী ইউরােপীয় সভ্যদের অপেক্ষাও অনেক অংশে সাহসী; হেত ফলাফল বােধ নাই। আমি তাই আমার সাহসের বিশেষ গৌরব করি না। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে সাহসের ভাগ কমিয়া আইসে; পেনাল কোড যত ভালাে হয় সাহস তত অন্তর্হিত হয়।
একদিন অপরাহ্লাে পাহাড়ের দিকে যাইতেছিলাম, পথিমধ্যে কতকগুলাে কোলকন্যার সহিত সাক্ষাৎ হইল।
তাহাদের মধ্যে যে- সর্বাপেক্ষা বয়ােজ্যেষ্ঠা- মাথায় পূর্ণ কলস দুই হস্তে ধরিয়া হাস্যমুখে আমায় বলিল,
‘রাত্রে নাচ দেখিতে আসিবেন?' আমি মাথা হেলাইয়া স্বীকার করিলাম, অমনি সকলে হাসিয়া উঠিল। কোলের যুবতীরা যত হাসে, যত নাচে, বােধহয় পৃথিবীর আর কোনাে জাতির কন্যারা তত হাসিতে নাচিতে পারে না;আমাদের দুরন্ত ছেলেরা তাহার শতাংশ পারে না।
সন্ধ্যার পর আমি নৃত্য দেখিতে গেলাম; গ্রামের প্রান্তভাগে এক বটবৃক্ষতলে গ্রামস্থ যুবারা সমুদয়ই আসিয়া একত্র হইয়াছে। তাহারা ‘খোঁপা বাঁধিয়াছে, তাহাতে দুই- তিনখানি কাঠের ‘চিরুনি’ সাজাইয়াছে। কেহ মাদল আনিয়াছে, কেহবা লম্বা লাঠি আনিয়াছে, রিক্তহস্তে কেহ আসে নাই; বয়সের দোষে সকলেরই দেহ
চঞ্চল, সকলেই নানাভঙ্গিতে আপন আপন বলবীর্য দেখাইতেছে। বৃদ্ধেরা বৃক্ষমূলে উচ্চ মৃন্ময়-মঞ্চের উপর
জড়বৎ বসিয়া আছে, তাহাদের জানু প্রায় স্কন্ধ ছাড়াইয়াছে। আমি গিয়া তাহাদের পার্শ্বে বসিলাম।
এই সময় দলে দলে গ্রামস্থ যুবতীরা আসিয়া জমিতে লাগিল; তাহারা আসিয়াই যুবাদিগের প্রতি উপহাস আরম্ভ করিল, সঙ্গে সঙ্গে বড় হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। উপহাস আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কেবল অনুভবে স্থির করিলাম যে যুবারা ঠকিয়া গেল। ঠকিবার কথা, যুবা দশ-বারােটা, কিন্তু যুবতীরা প্রায় চল্লিশ
জন, সেই চল্লিশ জনে হাসিলে হাইলন্ডের পল্টন ঠকে।
হাস্য-উপহাস্য শেষ হইলে, নৃত্যের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে হাত ধরাধরি করিয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতি
রেখাবিন্যাস করিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে বড় চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম-উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কালাে। সকলের মাথায় বনপুষ্প, কর্ণে বনপুষ্প, ওষ্ঠে হাসি। সকলেই আহ্লাদে পরিপূর্ণ, আহ্লাদে চঞ্চল ।
বৃদ্ধেরা ইঙ্গিত করিলে যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল; পরেই
তাহারা নৃত্য আরম্ভ করিল। তাহাদের নৃত্য আমাদের চক্ষে নতুন, তাহারা তালে তালে পা ফেলিতেছে, অথচ
কেহ চলে না; দোলে না, টলে না। যে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, সে সেইখানেই দাঁড়াইয়া তালে তালে পা
ফেলিতে লাগিল।
নৃত্য আরম্ভ হইলে পর এক বৃদ্ধ মঞ্চ হইতে কম্পিত কণ্ঠে একটি গীতের ‘মহড়া’ আরম্ভ করিল, অমনি যুবারা সেই গীত উচ্চস্বরে গাহিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে যুবতীরা তীব্র তানে ‘ধুলা ধরিল। যুবতীদের সুরের ঢেউ
নিকটের পাহাড়ে গিয়া লাগিতে লাগিল।
যুবতীরা তালে তালে নাচিতেছে, তাহাদের মাথার বনফুল সেইসঙ্গে উঠিতেছে নামিতেছে, আবার সেই ফুলের দুটি-একটি ঝরিয়া তাহাদের স্কন্ধে পড়িতেছে। শীতকাল নিকটে, দুই-তিন স্থানে হু হু করিয়া অগ্নি।
জলিতেছে, অগ্নির আলােকে নর্তকীদের বর্ণ আরাে কালাে দেখাইতেছে; তাহারা তালে তালে নাচিতেছে,
নাচিতে নাচিতে ফুলের পাপড়ির ন্যায় সকলে একবার ‘চিতিয়া পড়িতেছে, আকাশ হইতে চন্দ্র তাহা দেখিয়া।
হাসিতেছে, আর বটমূলের অন্ধকারে বসিয়া আমি হাসিতেছি।