রচনা: শ্রমের মর্যাদা

রচনা: শ্রমের মর্যাদা
অথবা: শ্রমের মূল্য
অথবা: সভ্যতা বিকাশে শ্রমের অবদান
অথবা: জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের গুরুত্ব
বাংলা রচনা ভান্ডার

ভূমিকা : শ্রমই বর্তমান দুনিয়ার সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার। বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তিতে সভ্যতার এ চরম সমুন্নতির দিকে তাকিয়ে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। সভ্যতার এ চরম বিকাশের মূলে রয়েছে যুগ যুগান্তরের লক্ষ কোটি মানুষের অক্লান্ত শ্রম। মানুষ তার শ্রমে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এ তিলােত্তমা ভবন। তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় ঠাই পায়নি। বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেক মানুষকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয় এবং এ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রধান হাতিয়ার হলাে পরিশ্রম। সভ্যতার আদি পর্ব থেকে চলমান এ যুদ্ধে।শ্রম ও সাধনায় জয়ী হয়ে অস্তিত্বকে রক্ষা করেছে। মানুষ জানে শ্রমই হচ্ছে অমরতা অর্জনের প্রধান সােপান।


পৃথিবীতে শ্রমের মর্যাদা : মানব সভ্যতার প্রতিটি স্তরে শ্রমের অবদান রয়েছে। সেই আদিম যুগে মানুষ কায়িক ও মানসিক শ্রমে তীর ও নৌকা চালানাে শিখেছে; শিখেছে পশু শিকার করে মাংস খাওয়া। সভ্যতার কৈশােরে মানুষ চাষাবাদ শুরু করেছে। এরপর শিখেছে প্রাসাদ নির্মাণ, নগরপত্তন, পথঘাট তৈরি। সাম্প্রতিক যুগে মানুষ মানসিক ও কায়িক শ্রম দ্বারা সভ্যতার চরম শিখরে আরােহণ করেছে।

প্রকারভেদ : শ্রম মূলত দুই ধরনের। কায়িক শ্রম এবং মানসিক শ্রম। মানব সভ্যতার বিকাশে এ উভয় প্রকার শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য।উভয় প্রকার শ্রমই সুফল বয়ে আনে। জগতের সুখ-শান্তি, ঐশ্বর্য, সম্মান, প্রতিপত্তি সবকিছু এ শ্রমের ওপর নির্ভরশীল।
বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবস্থাপনাবিদদের পরিশ্রম মূলত মানসিক। তবে তাদের এ মানসিক শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে তারা কায়িক শ্রমেও অংশগ্রহণ করেন। বাধাধরা নিয়মের মধ্যে না হলেও তাদের কায়িক শ্রম অবহেলার নয়। রটিন মাফিক নিয়মিত কায়িক শ্রমে অংশ নেয় সমাজের কুলি-মজুর, শ্রমিক প্রভৃতি সাধারণ জনগণ। অর্থ ও সামাজিক পদমর্যাদা।তাদের কম কিন্তু সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাদেরই ঘামে, রক্তে তথা শ্রমে।

শ্রমের সুফল : বস্তত কারাে শ্রম বিফলে যায় না। অন্যদিকে শ্রম ব্যতীত কোনাে ব্যক্তি বা জাতি উন্নতি করতে পারে না। হযরত মুহম্মদ (স) হেরা পর্বতের গুহায় রাত-দিন অতিবাহিত করেছেন। সেখানে তার দৈহিক ও মানসিক শ্রম ছিল বিস্ময়কর। সাধারণ সৈনিক থেকে নাসির শাহ হয়েছিলেন সম্রাট। দাস কতুবুদ্দিন হয়েছিলেন দিল্লির সুলতান আর ঈশ্বরচন্দ্র হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। শ্রমের গুণে আহমেদাবাদ
টেক্সটাইল মিলের সামান্য শ্রমিক থেকে স্বাধীন ভারত গড়ার অন্যতম কারিগর হয়েছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল।শ্রমের গুণেই বােম্বাই আদালতের সাধারণ আইনজীবী মুহম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রমের এরূপ উকৃষ্ট উদাহরণ অজস্র। মূলত অসাধারণ সাফল্যের জন্য অবশ্যই কঠোর শ্রমের দরকার। এজন্যই প্রবাদ আছে-

“পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি।”

শ্রমের অবমাননা : শ্ৰম সম্মান হানিকর নয়। শ্রমকে অস্বীকার করা মানেই নির্মল আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা এবং নিজেকে শয়তানের দোসরে পরিণত করা। একমাত্র শ্রমেই চিত্তশক্তি এবং আত্মার জাগরণ নিহিত। অথচ আমাদের দেশে কায়িক শ্রমকে আজও
অমর্যাদাকর বিবেচনা করা হয়। ফলে ক্রমশ আমরা উন্নত দেশগুলাের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছি। সর্বাধিক পার্থিব উন্নতি মূলত শ্রম সামর্থ্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত কায়িক শ্রম আত্মসম্মানের পক্ষে বিন্দুমাত্র হানিকর নয় বরং মানবসমাজে উন্নতির শ্রেষ্ঠ উপায়।

জাতীয় জীবনে শ্রমের মর্যাদা; আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। দেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত। জাতির এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা। লক্ষ করলে দেখা যায় ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা, জাপান, জার্মানির উন্নতির মূলে কঠোর পরিশ্রম। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে শ্রমের মূল্যায়ন করা জরুরি।

উপসংহার : যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে। শত শত সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপরে শ্রমিকসমাজ সভ্যতার বেদীমূলে অকাতরে তাদের শ্রম ঢেলে দিয়ে নীরবে কাজ করে এসেছে। তাদের কর্মের জয়ােল্লাসে মুখরিত পৃথিবীর পথ-প্রান্তর। কিন্তু তারা তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। আজ পৃথিবীতে নবযুগ এসেছে। তাই বৃথা আভিজাত্যের ভাব ত্যাগ করে শ্রমকে মর্যাদার বহু বলে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি মানুষকে স্মরণ রাখতে হবে একমাত্র শ্রম-সাধনার মাধ্যমেই মানুষ এ বিশ্বে নিজ ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে। কেননা পবিত্র কোরআনে আছে - “লাইসালিল ইনসানাে ইল্লামাসা-আ।” অর্থাৎ মানুষ শ্রম ছাড়া বাঁচতে পারে না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url