সর্বপ্রথম যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিল বিমান বা উড়োজাহাজ

মানুষের মনে-মগজে পরিব্রাজনের চেতনা ও স্বপ্ন। কূপমণ্ডুকের মতন সময় যারা আলস্যে নিঃশেষ করতে চায়, সেই নির্বোধদের সংখ্যা সর্বকালে, সর্বসময় ও  সর্বদেশে ব্যাপক নয় বলেই মনুষ্য সভ্যতা নিঃশেষিত হবার পরিবর্তে নতুন বৈচিত্র্যে পল্লবিত হয়ে উঠেছে।
সব প্রয়াসের মূলেই রয়েছে স্বপ্ন ও বাসনা। স্বপ্ন ও বাসনা থেকেই আসে নিরলস সাধনা। অর্জিত হয় বিবিধ বৈজ্ঞানিক ভেলকি। এককালে এই পৃথিবীর কিছু সংখ্যক মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা
নীলাকাশে পাখি হয়ে উড়ে যাবেন । খুশিমতন এখানে ওখানে যাচ্ছেন, নামছেন, অনেক উঁচু থেকে দেখছেন নীচের সুন্দর পৃথিবীকে। আপন ডানার ছন্দে নিজেকে বিভাের করে রেখেছে। ব্যাপারটা অলীক। অবিশ্বাসীরা তাচ্ছিল্যে ঠোট নাড়বে।
বিমান তৈরির ইতিহাস
Image Source : Internet 
সেই ছবির আদলে প্রথম যিনি পাখি হতে চাইলেন, তিনি বেসিমা শহরের এক যন্ত্রবিদ ফ্রাঙ্কি। তিনি চওড়া লােহার পাতের ওপর কাপড় জড়িয়ে জড়িয়ে একজোড়া ডানা তৈরি করলেন। তারপর ওই ডানা জোড়াকে নিজেই দুই হাতের সঙ্গে বেঁধে উড়তে প্রস্তুত হলেন। স্ত্রী একবার সংশয় প্রকাশ করাতে তিনি ক্ষেপে গেলেন। এরপর সে বিশেষ ভঙ্গিমায় চারতলার ছাদে উঠে গেলেন। সেখান থেকে কার্ণিশের ওপর । নীচে দলে দলে নর-নারী সকৌতুকে চেয়ে আছে। মা মেরীর নাম স্মরণ করে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলেন ফ্রাঙ্কি। 

দুই হাতের সঙ্গে সেট করা ডানা প্রাণপণে ঝাপটাবার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু কিছুতেই দেহটা তার ওপরের দিকে ওঠে না, শূন্যেও ভাসমান থাকে না, বরং অনিবার্যভাবে নেমে আসতে থাকে নীচের দিকে। তবে দুই ডানায় বাতাস কাটাবার জন্য তিনি তার দেহ নিয়ে মাটিতে প্রবল বেগে আছড়ে পড়লেন না; একটু দূরে সরে গিয়ে নেমে গেলেন অন্য এক তিনতলা বাড়ির ছাদে। ফ্রাঙ্কির প্রয়াস ব্যর্থ । এই বাহ্য ব্যর্থতা বলে কোন শব্দ নেই। আপাতভাবে যা ব্যর্থ, পরবর্তী সফল প্রয়াসের সেটাই হয়তাে শুভ সূচনা।

ফ্রাঙ্কি যেখানে শেষ করলেন, ব্যাকভিল সেখান থেকেই শুরু করলেন। ইনিও একজন ফরাসী। ছােটবেলা থেকেই যন্ত্র-টন্ত্র নিয়ে সময় কাটাতে ভালবাসতেন। তাঁর একটা হিল্লে হবে বলে বাবা-মা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে পাঠান ভার্সাইতে। ডিগ্রি পেলেও চাকরি নিলেন না ব্যাকভিল । আসলে তদ্বির-তদারকির মাধ্যমে চাকুরি একটা জুটিয়ে সারাটা জীবন অপরের গাধাবােট হয়ে থাকতে তাঁর মন সায় দেয়নি। তাঁরও মনে সেই দুর্নিবার বাসনা, পাখির মতােন ডানা মেলে মহাশূন্যে পাড়ি জমাবাে। নিছক স্বপ্ন দেখা বা হেঁদো কথায় আসর মাৎ করা নয়। ব্যাকভিল সত্যি সত্যি তাঁর কারিগরী বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে এক জবরদস্ত ডানা তৈরির সাধনায় ব্রতী হলেন। 


ফ্রাঙ্কির মতােন মােটা ও সরল বস্তু নয়, অনেক পাতলা, অথচ মজবুত এবং জটিল। ঢাক-ঢােল পিটিয়ে লােকজন জোগাড় করে অনেককে ভাবনায়-ব্যাকুলতায় চঞ্চল রেখে ব্যাভিল শূন্যে উড়লেন। দুই ডানার ভীষণ ব্যস্ততায় বাতাস তােলপাড়-যন্ত্রবিদ মানুষটা উড়ে উড়ে সীন নদী পার হচ্ছেন। অল্প দূরত্ব পাড়ি দেওয়া নয়। সে সবুরও তাঁর ছিল না। প্রথম প্রয়াসেই দুনিয়ার সব মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে চান তিনি। কিন্তু সেই জোরজবরদস্তি চুপসে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। মাঝ নদীর আকাশে পৌঁছে গিয়ে প্রমাদ গুণলেন ব্যাকভিল। তার ডানা দুটো আর তেমন কাজ করছে না, ওই প্রাথমিক হুজুতিতেই কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এতদিনের প্রয়াসী সৃষ্টি ডানাদুটো আদতে নেহাৎ ক্ষীণজীবী।

ব্যাভিলের কোষে কোষে আতঙ্ক ও হতাশা। তিনি দ্রুত নেমে আসছেন নদীর দিকে। ডানা দুটো কেবল এখন অক্ষম নয়, বেঢপ ওজনদারও লাগছে তাঁর কাছে। নদীতে অবশ্য পড়লেন না ব্যাভিল । পড়লে ভালই হতাে, হয়তাে এতটা আহত হতেন না। কিন্তু আছড়ে পড়লেন ভাসমান একটি আদিকালের পালতােলা নৌকার ওপর। ভেঙ্গে গেল তার কোমর ও শিরদাঁড়া ।

জীবনের বাকিদিনগুলিতে ব্যাভিল আর সােজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন নি। অন্য পাঁচজনের দয়া ও যত্ন আত্তির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়েছে তাকে।

ওই দুই ঘটনায় ধারণা হল, ডানা বানিয়ে আকাশে ওড়ার চেষ্টাটা নিছক ছিরিছাদহীন পাগলামি, ভয়ঙ্কর বিপদ সূচক। উড়তে যদি হয়ই, অন্য কোন উপায়ের কথা ভাবতে হবে । উপায়ের সন্ধানে নেমে পড়লেন ফ্রাঙ্কের দুই ভাই। তারা খুব যত্ন করে পরিচর্যা চালিয়ে প্রস্তুত করলেন এক অতিকায় বেলুন । বেলুনটাতে ভরা হল গ্যাস। দুই ভাই নিয়ত অভ্যাসে ওই বেলুন ধরে শূনে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করেন আবার নিশ্চিন্তে মাটিতে ফিরে আসেন। একদিন সাহস করে দুই ভাই বেলুনে কায়দা করে বসে পড়লেন। বেলুন তাদের নিয়ে হেলে-দুলে উঠল আকাশে । অনেক উঁচুতে অবশ্য ওঠা গেল না; তবে অনেক সুউচ্চ অট্টালিকার মাথা ছাপিয়ে তারা ভাসতে থাকেন । পরে এক সময় গ্যাস কমে এলে ধীরে ধীরে তারা মাটির বুকে নেমেও এলেন।

ঘটনাটির দর্শক কয়েক'শ নর-নারী । মাটিতে দিব্যি বেলুন ও তার আরােহীদের নিরাপদ শয্যা রচনা করতে দেখায় দর্শককূল সহর্ষে হাততালি দিয়ে ওঠে। দুই হামাগুড়ি দেওয়া শিশুর মতন দুই ভাই ও সানন্দে লাফিয়ে উঠলেন । সেই সাফল্যে যেন নব উদ্দীপনায় উদ্বেল । হরেক মানুষ রুটিন মাফিক তৎপরতায় বেলুন আর বেলুন তৈরি করতে থাকে। বেলুনে ধোয়া ঢুকিয়ে সকলের প্রয়াস, আকাশ পথে পাড়ি জমানাে। কেউ খানিকটা বা অনেকটা উঠে নিরাপদে ভূমিতে অবতরণ করেন। অনেকেরই আবার নামতে গিয়ে বিপত্তি। হাত ভাঙ্গে, পা ভাঙ্গে মাথা ফাটে । সব মিলিয়ে কিছু মানুষের পাগলামি বা বিচ্ছিন্ন প্রয়াস। নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির ঘটনা তখনাে ঘটেনি।

বেলুনে চেপে উড়তে গিয়ে প্রথম যিনি বলি হলেন, তিনি রেজিসান । রােজিয়ার তার বেলুনে ধোয়ার পরিবর্তে ঢুকিয়ে ছিলেন হাইড্রোজেন গ্যাস। তারপর সেই বেলুনে ঝুলে যখন তিনি মাঝ আকাশে, অবশেষে বেলুনে ধরে গেল আগুন। আকাশ থেকে রােজিয়ারের মৃতদেহ আছড়ে পড়ল একটা পাহাড়ের ওপর। সেই দুঃখজনক ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই সতর্ক হলেন । কিন্তু দমে গেলেন না। 

রােজিয়ারের মৃত্যুর তিনমাসের মধ্যেই আকাশে উড়বার
চমকপ্রদ কৃতিত্ব দেখালেন জেফ্রিস। জেফ্রিসের বাড়ি অ্যামেরিকায়। বয়সে তরুণ, মনে অদম্য সাহস । তিনি

বেলুনে চেপে ইংল্যাণ্ডের উপকূল থেকে উড়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে অবতরণ করলেন ফ্রান্সের মাটিতে। চারিদিকে একেবারে ধন্য ধন্য পড়ে গেল ।

কিন্তু বেলুন যুণ থেকে বিমান যুগে মানুষ সহজে প্রবেশ করতে পারেনি জেফ্রিসের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেবার পর আরাে কয়েক যুগ অতিবাহিত হল। অভিযাত্রীরা ক্রমশ উচুতে আরাে উচুতে উঠতে লাগলেন । কিন্তু বিমান তৈরির কলাকৌশল তখনও তাদের কব্জায় এল না। ওই উঁচুতে উঠবার ব্যাপারে সবচেয়ে বাহাদুরি দেখালেন দুই তরুণ কক্সওয়েল এবং গ্লানিয়ার । কক্সওয়েল ও গ্ল্যানিয়ার তাঁদের হাইড্রোজেন ভর্তি বেলুন চেপে এতদূরে উঠলেন, যা এতকাল ছিল অকল্পনীয়।
 মাটি থেকে তারা উঠে গেলেন দশ মাইল ওপরে । কিন্তু ওই অত উচ্চতায় অক্সিজেনের যে বেশ অভাব! ফলে
মহাশূন্যে দু'জনেরই শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়। বুদ্ধিমান কক্সওয়েল ওই সময় তাঁদের বেলুন থেকে অনেকটা হাইড্রোজেন গ্যাস বের করে দেন। ফলে বেলুনটা আবার ধীরে ধীরে তাদের নামিয়ে আনল মাটিতে। প্রাণে বেঁচে গেলেন কক্সওয়েল ও গ্লানিয়ার ।

প্রত্যেক অভিযাত্রীই স্বীকার করলেন, বেলুনে চেপে শূন্যপথ পাড়ি দেওয়ার ঝকমারি অনেক। বেলুন তার খুশিমতন ওড়ে, এগিয়ে যায়, যেখানে-সেখানে নেমে পড়ে; অভিযাত্রীর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তার ওপর। সবটাই একটা অনিশ্চিত, ঝুঁকিবহুল ব্যাপার। সুতরাং, এমন যন্ত্র আবিষ্কার করতে হবে, যার দ্বারা বেলুনের উডডীন তথা গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মাটিতে যেমন মটোর গাড়িকে ইচ্ছামতন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আকাশযানকেও তেমনি সুনিশ্চিত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আকাশযানকে যন্ত্রের অধীনে আনবার নির্দিষ্ট গবেষণায় প্রথম সাড়া তুললেন অটো লিলিয়েন্থাল নামক এক যন্ত্রবিদ। তিনিই যন্ত্র চালিত গ্লাইডারের আবিষ্কারক। সেই গ্লাইডারে চেপে তিনি খানিকটা আকাশে উঠেও গেলেন। তারপর মর্মান্তিক পরিণতি-গ্লাইডারটা আছড়ে পড়লাে মাটিতে। মারা গেলেন অটো লিলিয়েন্থাল ।

অটো লিলিয়েন্থাল মারা গেলেও তার প্রদর্শিত পথেই সাফল্য এল ।
বহু যন্ত্রবিদই গ্লাইডার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। শেষাবধি সফল হলেন দুই মার্কিন ভ্রাতা-রাইট ভ্রাতৃদ্বয় । তারা দু'জনে প্রথম আবিষ্কার করলেন নিখুঁত যন্ত্রচালিত বিমান, যার সাহায্যে তারা আকাশে উড়লেন, ইচ্ছেমতন গতিপথ পরিবর্তন করলেন, আবার নিরাপদে মাটির বুকে ফিরেও এলেন ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url