ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয় কিভাবে ও কয়েকটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে গেল ঘূর্ণিঝড় আমফান। যার বিধ্বংসী রুপ সম্পর্কে সকলেই কম বেশি জানে। প্রতিবছর বৈশাখ জৈষ্ঠ্যমাসে আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড় হানা দেয়। যেগুলোর নতুন নতুন নাম থাকে যেমন ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, সিডর আরো কতো কি। তবে আমরা অনেকেই জানতে চাই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় কিভাবে।
একারনেই আজ কয়েকটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য এবং ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কিভাবে হয় ও কেনইবা মেয়েদের নামে নাম রাখা হয়।
১.হারিকেন ইরমা
১.হারিকেন ইরমা
হারিকেন ইরমা সৃষ্টি ২০১৭ সালের ৩০শে আগস্ট। এটি ৬ সেপ্টেম্বর বারবুডা দ্বীপে আঘাত হানে এবং দ্বীপটির ৯০ শতাংশই এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ১০ সেপ্টেম্বর এটি ক্যাটাগড়ি ৫ মাত্রার হারিকেনে পরিণত হয়। এর সর্বোচ্চ গতি ছিল প্রায় 300 কিলোমিটার। ইরমা ঘূর্ণিঝড় এর প্রবলতার জন্য একাধিক রেকর্ড করেছিল। ঝড়টি দীর্ঘসময় পূর্ণশক্তি ধরে রেখেছিল। এটি গতিপথে পুয়ের্তোরিকো, হাইতি, কিউবা এবং ফ্লোরিডায় আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়টির কারণে অনেক এলাকায় ভূমিধস হয়। ঘূর্ণিঝড় ইরমার কারণে ৭৭.১৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় এবং ২৮ জন মানুষ নিহত হয়।
২. হারিকেন মাইকেল
ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে এই ঘূর্ণিঝড় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূলে আঘাত হানে। এটি ক্যাটাগরি ৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। হারিকেন মাইকেল যুক্তরাষ্ট্রেই একাধিক রেকর্ড গড়ে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় শক্তিশালী ঝড়। এর আগে এই ১৯৩৫ সালের শ্রমিক দিবসের হারিকেন ও ১৯৬৯ সালের হারিকেন মাইকেল ছিল প্রলয়ঙ্কারী। এটি ফ্লোরিডার প্যানহান্ডলে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিধসকারী হারিকেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ শক্তিশালী ভূমিধসকারী হারিকেন। এই হারিকেনের চাপ ছিল ৯১৯ মিলিবার। ২৫.১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সহ ৭৪ মানুষ নিহত হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে এটিই নাকি ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড়।
৩.টাইফুন জেবি
১৯৯৩ সালের পর জাপানে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় এটি এবং ২৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়। ২৬ শে আগস্ট গ্রীষ্মমণ্ডলীয় নিম্নচাপের প্রভাবে এটি সৃষ্টি হয় এবং পরেরদিন এটি তীব্রতর ও শক্তিশালী হয়। ৩১শে আগস্ট এটি মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে আঘাত হানে এবং ২রা সেপ্টেম্বর ঘন্টায় ২১৬ কিলোমিটার বেগে জাপানে আঘাত হানে। এছাড়াও যে যে জায়গায় এটি প্রভাবে ফেলে তারমধ্যে আছে তাইওয়ান ও রাশিয়ার সুদূর পূর্ব। বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ২৮৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ১৭ জন মারা যায় এবং ১২.৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
৪.টাইফুন নিনা
টাইফুন নিনা ১৯৭৫ সালের ৩০শে জুলাই তৈরি হয় এবং ৩১শে জুলাই এটি চীনে আঘাত হানে। এটি ভয়াবহ একটি ঘূর্ণিঝড় ছিল । অন্তত ২ লাখ ২৯ হাজার মানুষ এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মারা যায়। টাইফুন নিনা ছিল চতুর্থ প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়। এর গতিবেগ ছিল ২২২ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা।
বৃষ্টিপাতও হয় প্রচুর(৭০০ মিলিমিটার)। যার কারণে বন্যা দেখা দেয় এবং ৩ হাজারেরও বেশী ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাড়ায় ১.২ বিলিয়নের উপরে।
৫.হারিকেন প্যাট্রিসিয়া
হারিকেন প্যাট্রিসিয়া একটি ভয়াবহ শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। এটি বাতাসের গতির দিক দিয়ে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বায়ুমন্ডলীয় চাপের দিক দিয়ে ২য়। এর সর্বনিম্ন বায়ুমন্ডলীয় চাপ ছিল ৮৭২ মিলিবার এবং বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৩৪৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। সেন্ট্রাল আমেরিকা, টেক্সাস ও মেক্সিকো আক্রান্ত হয় এই হারিকেন দ্বারা। আর্থিক ক্ষতি হয় ৪৬২.৮ মিলিয়ন ডলার এবং মোট নিহতের সংখ্যা দাড়ায় ১২ জনে।
ঝড়ের নামকরণ হয় কীভাবে?
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কিভাবে করা হয় এ নিয়ে হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে। আসলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা(WMO)-এর অধীনে বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ২৩ মার্চ ১৯৫০ সালে গঠিত হয়। এর সদস্য রাষ্ট্র ১৯৩। উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সকল ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে এই সংস্থার ৮টি সদস্যরাষ্ট্র। এগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা। প্রথম প্রথম ঝড়ের নামকরণ করা হতো নারীর নামে কিন্তু পরবর্তীতে আবার বিভিন্ন বস্তু বা জিনিসের নাম দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু হলো বায়ু, মেঘ, সাগর ইত্যাদি। উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ঝড়গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এই পর্যন্ত ৮টির নামকরণ করেছে। এগুলো হলো- অগ্নি, নিশা, গিরি, হেলেন, চপলা, অক্ষি ও সর্বশেষটা হলো ফণী।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কেন নারীর নামে করা হয়?
ঘূর্ণিঝড় নিয়ে প্রচলিত বহুল প্রশ্নগুলোর একটি হচ্ছে, বেশীরভাগ ঘূর্ণিঝড়ের নাম কেন নারীর নামে করা হয়? যেমন- নার্গিস, বিজলী, ক্যাটরিনা, ইত্যাদি।
এ নিয়ে আবার অনেকে হাসি-ঠাট্টা ও করে থাকেন। আগে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হতো অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের উপরে ভিত্তি করে। আসলে ঘূর্ণিঝড়ের ধরনের উপর নির্ভর করে একে সহজ নামকরণ করার চেষ্টা করা হয় যাতে মানুষ সহজেই মনে রাখতে পারে। আর মানুষ নারীর নাম সহজে মনে রাখতে পারে এবং ভুলে না বিধায় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের ক্ষেত্রে নারীদের নামকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। ১৯৭৯ সালের পর পুরুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন - ২০১৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশে আঘাত হানা এক ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ছিল মহাসেন। তৃতীয় শতকের সিংহল রাজার নাম থেকে এর নামকরণ করা হয় ঘূর্ণিঝড় মহাসেন। ঘূর্ণিঝড় সরাসরি মৃত্যু ও ধ্বংসের সাথে জড়িত বিধায় কোনো ঘূর্ণিঝড়ের নাম দুইবার করা হয় না।