সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজের আদ্যোপান্ত
যুদ্ধ অতীব ভয়ঙ্কর, যুদ্ধের আয়ুধ সাবমেরিন (submarine) আরাে ভীষণ জঘন্য।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে জার্মানীর একাধিপতি হের হিটলার তার অন্তিম উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন ওই সাবমেরিনের মাধ্যমে। পানির তলায় হিংস্র হাঙ্গরের মতন ছুটতে ছুটতে সাবমেরিন শত্রুর জাহাজকে লক্ষ্য করে টর্পেডাে নিক্ষেপ করে। টর্পেডাের আঘাতে জাহাজের খােলে ফাটল ধরে। জার্মান ক্যাপ্টেন তারুণ্যের আনন্দে ও উল্লাসে হাততালি দিয়ে ওঠেন।
আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে মিত্রপক্ষের ত্রাহি ত্রাহি রব শুরু হয়। পানির তলায় কখন যে সেই বিস্ফোরক স্পর্শানুভূতি সর্বনাশের সূচনা করবে খােদায় মালুম। অবশ্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, অ্যামেরিকা বেশিদিন ওই রকম অসহায়ত্ব ও নির্জীবত্বে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেনি। তারাও পাল্টা ব্যবহার করতে শুরু করে সাবমেরিন । সাতগে টর্পেডাে তো আছেই কেবল তাই নয়, ডেপথচার্জ করে ধ্বংস করতে থাকে শত্রুপক্ষের সাবমেরিন গুলিকে।
সাবমেরিন শব্দের অর্থ ডুবাে জাহাজ। বৈজ্ঞানিক গ্রন্থি মােচনের আর এক দারুণ আবিষ্কার। এই সেই জলযান, যা চালকের ইচ্ছানুযায়ী কখনাে পানির তলায়, কখনাে পানির ওপরে। সাবমেরিন আকারে লম্বাটে। পেটটা মােটা,মাথা ও লেজের দিকটা ক্রমশঃ সরু। এই জাহাজের মাঝখানটা ফাঁপা। ওই ফাপা অংশ পানি ও বাতাসে ঠাসা। পানির মধ্যে ওঠা-নামা করবার জন্য প্রতিটি সাবমেরিনে অনেকগুলি পানির ট্যাংক রাখা আছে। পানির তলায় ডুব দিতে হলে যন্ত্রের সাহায্যে অতি দ্রুত ওই ট্যাঙ্কগুলিকে পানি ভর্তি করা হয়। ফলে পানির ভারে জাহাজ ডুব দেয় গভীরে। আবার যখন ভেসে উঠবার দরকার হয়, ট্যাঙ্ক গুলিকে পানিশূন্য করে ফেলা হয় এবং জাহাজ ভুস করে ভেসে ওঠে পানির ওপর।
সাবমেরিন চালিত হয় দু' ধরনের ইঞ্জিনের সহায়তায়। পানির তলায় যখন সে চলাচল করে তখন ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক মােটর। আর পানির ওপর যখন সে চলে তখন পেট্রল বা ডিজেলের ইঞ্জিন। পানির তলায় সাবমেরিন যখন সাতার কাটে, এর যাত্রীদের কাছে সেই মুহূর্ত গুলি ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। চারপাশে কাচের আস্তরণ অনেকটা যেন সেজুকরা বাসী ডিমের মতন ফ্যাকাশে। শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার জন্য যে বাতাসের প্রয়োজন, তা আসছে সুরকেল নামক এক ফাপা নল দিয়ে। আর সমুদ্রের ওপরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পেরিস্কোপ নামক যন্ত্রের সাহায্যে।
সাবমেরিন মূলত নিঃশব্দ, কারণ শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য অনেকগুলি কুলুঙ্গির মতন মেশিন কাজ করে যাচ্ছে । ঠিক ঠিক সাবমেরিন না হলেও পৃথিবীতে প্রথম যিনি ডুবাে জাহাজ আবিষ্কার করেন, তার নাম রবার্ট ফুলটন (Robert Fulton)। তিনি যে বিশেষ জলযানটিকে পানির তলায় চালান দিয়ে আবার তা দিব্যি তুলে আনতে পারতেন। সেটির চেহারাটা হাঁসুয়ার মতন বাকা।
১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের ঘটনা। অনেক লােক আসত সেই অবাক কাণ্ড দেখতে। রবার্ট ফুলটনের নামানুসারে সেই জাহাজটারও নাম হয়ে গেল ‘ফুলটন'। ফুলটন কেবল ডুব দিতে পারে,বেশ কিছুক্ষণ পানির তলায় ঘাপটি মেরে থেকে আবার ভেসে উঠতে পারে।
কিন্তু সে পানির নীচে চলাফেরা করতে পারে না। চোরাগােপ্তা আক্রমণ হানা তাে দূরের কথা। তবে রবার্ট ফুলটনের ওই কেরামকিতকে খর চোখে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন একজন তিনি হলেন সাইমন লেক। লেক সাহেবই সর্বপ্রথম ডুবােজাহাজ-এ গতি আনতে সক্ষম হন। তাই ডুবাে জাহাজের আবিষ্কারক হিসেবে সাইমন লেককে সকলে স্বীকৃতি দেয়, যদিও প্রথম অবস্থায় ডুবােজাহাজ ছিল প্রায় এক প্রাচীন কচ্ছপ । সামান্য চলাফেরা করতে পারত মাত্র।সাবমেরিন ভীষণ গুরুত্ব পেয়ে যায় দুই মহাযুদ্ধে। প্রথম মহাযুদ্ধে এর এতটা ব্যবহার না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাবমেরিন একেবারে থরহরিকম্প লাগিয়ে দেয়। আবার সাবমেরিনকে নিকেশ করবার অস্ত্র ও আবিষ্কৃত হয় ওই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়।
বিজ্ঞানীরা এমন এক রাডার যন্ত্র আবিষ্কার করলেন, যার সাহায্যে অতলে লুকিয়ে থাকা বা ক্রম আগুয়ান সাবমেরিনের উপস্থিতি বিলক্ষণ টের পাওয়া সম্ভব হয়। এমন যন্ত্র ও আবিষ্কৃত হয়, যার সাহায্যে পানির তলায় সাতরে বেড়ানাে ডুবাে জাহাজের চাহা কণ্ঠ বা চিকন আওয়াজ দিব্যি যন্ত্রের সাহায্যে শুনতে পাওয়া গেল ।
শব্দ শােনার সঙ্গে সঙ্গে নিক্ষিপ্ত হল শব্দভেদী অস্ত্র।পানির তলায় ঘােমটা টানা এক ছায়ার মতন নড়াচড়া করছিল যে জলযান, মুহুর্তে তা চূর্ণ বিচুর্ণ! প্রতিপক্ষ খুশি । আপদ চুকে গেল।
এখন তাই রাশিয়া ও অ্যামেরিকা- এই দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রই সাবমেরিনের নিরাপত্তার জন্য দারুন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এমন সাবমেরিন বানাতে চায় যার আক্রমণাত্মক ক্ষমতা থাকবে দারুণ, আবার বেশির ভাগ মৃত্যুবানই সে হজম করে নিতে সক্ষম হবে।
এই দুই শক্তিই এখন তাদের বেশ কিছু সাবমেরিনকে পরমাণু শক্তির সাহায্যে চালাচ্ছে । এমন অনেক ডুবােজাহাজ তাদের আছে যেগুলি মাসের পর মাস সমুদ্রের তলাতেই ডুবে থাকতে পারে। প্রাচ্যে জাপানও ঐ রকম পরমাণুচালিত সাবমেরিন নির্মাণ করেছে । যুদ্ধ বিমানের উদরে বহন করা হয় যেমন বােমা,সাবমেরিনও তেমনি তার গহ্বরে রাখে টর্পেডােকে। ডুবাে জাহাজ ডুবাে বােমা। ওই ডুবাে বােমাটি এক কথায় মারাত্মক। প্রসঙ্গ উঠলেই নাকে যেন পােড়া গন্ধ লাগে । কেমন গোয়ার জানােয়ার, একবার নিক্ষেপ করলে তীব্র গতিতে গিয়ে ঠিক ঢুঁ মারবে প্রতিপক্ষের জাহাজে, অসাবধানে বা বেখেয়ালে কিছু নয় । পুরাদস্তুর সজ্ঞানে সে বিস্ফোরণ ঘটাবে, নিজেও মরবে, শত্রকেও ঘায়েল করবে। আদতে টর্পেডাে স্বয়ংক্রিয়। একটা ইলেকট্রিক মােটর ওকে চালনা করে। মাথায় লাগানাে আছে যেন দুই ডাকিনী চোখ। সেই চোখ যে মুহর্তে ঢুঁ মারে, সঙ্গে সঙ্গে প্রলয় বিস্ফোরণ।
এহেন মারণাস্ত্রের আবিষ্কারক একজন নৌ সেনাপতি। নাম স্যার লপিস।
অস্ট্রিয়ার অধিবাসী। সময় ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দ সেই সময় থেকে সাবমেরিনের কথা আলোচনায় এলেই টর্পেডাের প্রসঙ্গ অনিবার্য হয়ে ওঠে।