রচনাঃ গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ বা, গ্রামের পরিবেশ

রচনাঃ গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ
অথবা, গ্রামের শােভা
গ্রামের পরিবেশ রচনা
গ্রামের সৌন্দর্য রচনা
গ্রামের জীবন
রচনাঃ গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ

গ্রাম' শব্দটি উচ্চারণ করলেই একটা মধুর শান্ত-স্নিগ্ধ, ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, সবুজ প্রকৃতির ছবি স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,

“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি।
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছােট ছােট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলা গেহ
স্তন্ধ অঞ্চল দীঘি কালাে জল নিশীথ শীতল স্নেহ।”

গ্রাম হচ্ছে স্রষ্টার অকৃপণ সৌন্দর্যের সৃষ্টি। ইংরেজিতে একটি কথা আছে যে, "God made the village and man made the town." স্রষ্টার অকৃপণ সৌন্দর্যের আধার গ্রাম-বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

“আজি কি তােমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাতা বক্তা, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শােভাতে।
পারে না বহিতে নদী জল ধার
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল।
তােমার কানন সভাতে।”

গ্রামের প্রকৃতি যেমন সহজ সরল, সৌন্দর্যের আধার তেমনি গ্রামের মানুষগুলােও সহজ সরল ও অনাড়ম্বর। প্রকৃতির মতাে তাদের হৃদয়ও অত্যন্ত উদার, কোমল ও স্বাভাবিক সৌন্দর্যে বিকশিত। তারা শহরের মানুষের মতাে রূঢ়, কূটবুদ্ধি বা নিষ্ঠুর, বাস্তববাদী নয়। শহরের লােকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বাস্তব কথা বলেছেন।কথাটি হলাে,

“ইটের পরে ইট মাঝে মানুষ কীট
নাইকো ভালােবাসা, নাইকো স্নেহ।”

কিন্তু গ্রামের মানুষ অত্যন্ত উদার । অভাব-অনটন, রােগ-শােক, দুঃখ-দারিদ্র তাদের নিত্যদিনের সাথী। কিন্তু তারপরও তারা একে অন্যের সাথে পরম স্নেহ-মমতায় গলাগলি করে থাকে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষক। তারা ততটা শিক্ষিত নয়। তাদের জীবনে তেমন জটিলতা নেই। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, কে মঙ্গল গ্রহে না চাদে জমি কিনছে, কে সমুদ্রের তলদেশে অট্টালিকা বানাচ্ছে এসব জটিল রহস্যে তারা মাথা ঘামায় না। কেবল মাঠে ফসল ফলিয়ে দুমুঠো ডাল-ভাত পেটে দিতে পারলেই তারা নিশ্চিন্ত। একসময় তাদের সে চিন্তা মােটেও করতে হতাে না। তখন তাদের ছিল “গােলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গােয়াল ভরা গরু।” মাঠে মাঠে ফসলের সমারােহ কৃষকের মুখে হাসি বয়ে আনত ঋতুতে ঋতুতে। ফসল কাটার সময় তাদের ব্যস্ততার অন্ত থাকত না। কৃষকবধূ ফসলের কুটো অলঙ্কারের মতাে গায়ে ধারণ করত। নাকে স্বর্ণের নাকফুল হয়ে থাকত সুস্পষ্ট সােনালি ধান। ফসল কাটার আনন্দে তখন মুখরিত হয় মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। সর্বত্র তখন শুধু ধান আর ধান। বাড়ি বাড়ি শুরু হয় নবান্নের উৎসব। ফসল কাটা হলে কাজের চাপ কমে যায়। তখন গ্রামের মানুষ অবসরে মেতে ওঠে, নানা উৎসব-আনন্দে। জ্যোস্না রাতে দহলিজে বসে তারা শশানে জারি গান, সারি গান, পালা গান, মুর্শিদি- মারফতি গান, পুঁথি পাঠ, কেচ্ছা কাহিনী আরাে কত কী! কৃষকবধূ অবসর সময়ে সেলাই করে নকশি কাঁথা। সেই কাঁথার সেলাইয়ের মাধ্যমে মহাকাব্যিক হয়ে ওঠে তাদের নিজেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, বিরহ বেদনা, হাসি- কান্না, ইতিহাস-ঐতিহ্য সব।

দিনের বেলা রাখাল বালক গরু চরায় উন্মুক্ত মাঠে। গরু ছেড়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজায় মনের সুখে। বাঁশির সুরে মন উদাস হয়ে যায়। চলা কিশােরী হয়তাে সেই বাঁশির সুরে সখীকে ডেকে বলে-

“প্রাণ সখীরে
ঐ শােন কদম্ব তলে।
বাশি বাজায় কে ।
বাঁশি বাজায় কে রে সখি।
বাঁশি বাজায় কে
আমার মাথার বেণী খুইলা দিমু
তারে আইনা দে।”

সকালে উঠে কৃষক যখন লাঙল কাঁধে মাঠে কাজ করতে যায়, তখন কৃষকবধূ সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দুপুর হতে হতে রান্না-
বান্না সেরে অপেক্ষায় থাকে কখন ফিরবে তার ঘরের মানুষটি। এভাবে সুখে-দুঃখে, মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করে থাকে তারা। দ্বন্দ্ব কলহ,
বিরােধ-বিসংবাদ গ্রামের মানুষের মধ্যেও হয়, কিন্তু তা ততটা স্থায়ী হয় না। গ্রামের কোমল হৃদয়ের মানুষ তৎক্ষণাৎ ভুলে যায় সব। বিপদের মুহূর্তে সর্বস্ব দিয়ে সহযােগিতা করে প্রতিবেশীকে।

গ্রামের এ মধুর চিত্রগুলাে আগে যেমন ছিল এখন আর তেমনটি নেই। সভ্যতার অগ্রগতি, যান্ত্রিকতার করাল গ্রাস গ্রামেও থাবা বাড়িয়েছে। ‘ডাল ভাত' বা 'মাছে ভাতে বাঙালি'- প্রবাদটি এখন রূপকথায় পরিণত হয়েছে। দুঃখ-দৈন্য, রােগ-শােক, অভাব-অভিযােগ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা গ্রামের মানুষের সেই প্রাণের উজ্জ্বলতা কেড়ে নিয়েছে, হারিয়ে গেছে তাদের সুখ-স্বপ্ন। অতীত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাই কবি প্রশ্ন করেন,

“কবিতা!
বল না!
আজো কি সেই বুড়াে বটে
দুপুর রােদে চৈতী মাঠে
রাখালিয়া বাঁশির সুরে
বধূয়ার মন রয় না ঘরে?
আজো কি সেই ঝিলের জলে
ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাকালে
লাল পদ্মটি হাওয়ায় দোলে
- মায়ের কোলে?”

অথবা,
“আজো কি সেই শীতের পিঠা
মায়ের আদর স্নেহ-মিঠা।
বধূর মধুর স্নিগ্ধ হাসি
পল্লী বাংলার সবার কাছে।
তেমনি আছে?”

শুধু তাই নয়, যান্ত্রিকতার ছোঁয়া নগরের পাশাপ । গ্রামেও এখন অনেকটা লেগেছে। ফলে আগের সেই ছায়া সুশীতল সবুজে ঘেরা প্রকৃতি আর গ্রামেও তেমনটি লক্ষ করা যায় না। কিন্তু তারপরও গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের তুলনায় ভালাে আছে। শত দুঃখের মাঝেও তাদের হৃদয়ে প্রশান্তি আছে। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনাচরণই তাদের সেই প্রশান্তির মূল। তাদের এ প্রশান্তি, সমৃদ্ধি, সুখ আরাে বাড়বে, যদি দেশের সচেতন শিক্ষিত মানুষগুলাে তাদের প্রতি দৃষ্টি দেন। আর সেটাই হওয়া উচিত। কারণ গ্রামই এদেশের প্রাণ। গ্রাম ও গ্রামের মানুষ যদি বাঁচে তবে দেশও বাঁচবে। আর তারা যদি ধ্বংস হয় তবে দেশও টিকবে না। তাই আমাদের সবারই গ্রামােন্নয়নে বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া উচিত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url