ফেসবুকের ২১ টি ক্ষতিকর প্রভাব ও অপকারিতা
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সোস্যাল মিডিয়া হলো ফেসবুক। এর যেমন রয়েছে উপকারিতা তেমনই ফেসবুকের ক্ষতিকর প্রভাব ও কম নেই। অতিরিক্ত ব্যাবহারের ফলে ফেসবুক এর কুফল রয়েছে অনেক। একারনে ফেসবুক চালানোর অপকারিতা সম্পর্কে আমাদের সকলের জনা উচিত। এ কারনে আমরা আজ আলোচনা করবো অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যাবহারের ২১ টি অপকারিতা সম্পর্কে। ফেসবুক ও যুবসমাজ ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। তাই যুবসমাজের এই ক্ষতি এরাতে আমাদের যুবসমাজকে সচেতন করতে হবে।
ফেসবুকের আবার ক্ষতি কি? এটি তো নিতান্তই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। উপরন্তু ইদানীং এটিকে অনেকের ব্যবসা আর জীবিকার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছেন। কত্ত পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যায় এই ফেসবুকে—যুক্ত থাকা যায় পৃথিবীর সব প্রান্তের সঙ্গে। জানা যায় অনেক কিছু, এমনকি সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের চেয়েও দ্রুততর সময়ে হালনাগাদ তথ্যটি পাওয়া যায় ফেসবুকে। সবই তো ভালো। কথা সত্য। ফেসবুক সত্যিই ভালো। কিন্তু ‘ভালো’ভাবে এর ব্যবহার করতে না পরলে সমুদয় ক্ষতি। যেমন বিদ্যুতের কথাই ধরা যাক—বিদ্যুৎ কত উপকারী; বাতি জ্বলে, পাখা ঘোরে—বড় বড় কারখানা চলে বিদ্যুতে। কিন্তু একে ভালোবেসে বিদ্যুতের তার শরীরে জড়িয়ে রাখলে সমূহ বিপদ! তেমনি ফেসবুকের পরিমিত আর যৌক্তিক ব্যবহার করতে না পারলে ক্ষতি অনিবার্য।
ফেসবুকের প্রধান ২১টি ক্ষতি হচ্ছে:
১. ফেসবুক ব্যাবহারের ফলে সময় নষ্ট:
ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে ঢাকা শহর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটির কাছাকাছি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। ২০১৭ সালে তরুণদের ওপর পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী শুধু চ্যাটিংয়ের জন্য গড়ে প্রতিদিন ৮০ মিনিট করে ব্যয় করেন বাংলাদেশের তরুণেরা। (প্রথম আলো, জরিপ ২০১৭)। কানাডার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দৈনিক গড়ে ৩০ মিনিটের বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় ব্যয় করলে তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ফেসবুকে বেশি বেশি সময় নষ্ট হয়, এ সময়টিতে পড়ালেখা বা কাজ করলে ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা বাড়ত—যা জাতীয় আয়ে যুক্ত হতো।
২. অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যাবহারের ফলে সৃষ্টি হতে পারে হতাশা আর বিষণ্নতা:
ফেসবুকে মানুষ শুধু সফলতাকেই ফলাও করে প্রকাশ করে। আর বন্ধুদের এই একপেশে সফলতা দেখতে দেখতে একজন ব্যবহারকারী হতাশ হয়ে ওঠেন, ভাবেন—‘ইস, আমি কেন ওদের মতো না।’ এসব ভাবতে ভাবতে তিনি হয়ে ওঠেন হতাশ, আক্রান্ত হতে পারেন বিষণ্নতার মতো মানসিক রোগে। কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলেন—যার উৎস হচ্ছে ফেসবুক।
৩. বন্ধু হয়ে ওঠে পরশ্রীকাতর:
আপনার সফলতার বয়ান দেখতে দেখতে তথাকথিত বন্ধুরা আপনার প্রতি ঈর্ষাণ্বিত হয়ে ওঠেন, আপনার প্রতি কাজে ভুল ধরতে থাকেন, তীব্র সমালোচনায় জর্জরিত করেন—কখনো দেখা যায় বিকৃতমনস্ক ঈর্ষাকাতর ‘ফেসবুক বন্ধু’ আপনার মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেন ফেসবুকে। অহেতুক বিদ্বেষ প্রকাশ করেন। হতাশা প্রসবের খোলা পাত্র হয়ে ওঠে ফেসবুক।
৪. ফেসবুকের অপব্যবহারের ফলে জন্ম নেওয় ঈর্ষা:
আপনি আপনার ফেসবুক সাথিদের একটার পর একটা অর্জন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন— আপনার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে ঈর্ষার মতো একটি নেতিবাচক আবেগ, যা আপনার চিন্তা আর আচরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
৫. ভ্রান্ত ধারণা আর গুজব:
ফেসবুক থেকে আপনি একটা ভুল তথ্য জানছেন, সেটিকে শেয়ার করে গুজবের জন্ম দিচ্ছেন। এই ধরনের গুজব সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় জটিলতা তৈরি করে। এ কারনে ফেসবুক ব্যাবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
৬. নিরাপত্তাহীনতা:
অপরিচিত কারও সঙ্গে তৈরি হয় সম্পর্ক । আর অন্তর্জালে স্ট্রেঞ্জার মানেই ডেনজার। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছেন বিপদে, ফেসবুক থেকে। কিশোর–কিশোরীরা শিকার হচ্ছে সাইবার বুলিংয়ের। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের ২০১৮ সালের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি পাঁচটি মেয়েশিশুর মধ্যে একটি আর প্রতি ১০টি ছেলেশিশুর মধ্যে একটি সাইবার বুলিংয়ের শিকার। আর সাইবার বুলিং থেকে বিষণ্নতা, স্ট্রেস, আত্মহত্যার মতো বিষয়ের অবতারণা হয়।
৭. তথ্য উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া:
ফেসবুক মানুষের গোপনীয়তার ওপর আঘাত হানে। আপনার ঘুমের সময় থেকে শুরু করে আপনার সব গতিবিধি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এটি ব্যক্তির মর্যাদাবোধ কমায়।
৮. বিরক্তিকর মানুষের সান্নিধ্য:
যাঁদের আপনি পছন্দ করেন না, বাধ্য হয়েও সেসব ঈর্ষাকাতর বন্ধু, সহকর্মী ‘নরকের কীট’দের আপনার ওয়ালে রাখতে হয়। সামাজিক ভদ্রতাবশত আপনি হয়তো তাঁদের ব্লকও করতে পারছেন না । কিন্তু আপনার ওয়ালে তাঁদের বিরক্তিকর উপস্থিতি আপনার জন্য স্ট্রেসফুল।
৯. প্রেম বা দাম্পত্যে জটিলতা:
ফেসবুকে অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। কখনো সেটি নিছক বন্ধুত্ব আবার কখনো নতুন প্রেমের সম্পর্ক । এ সম্পর্কগুলো দাম্পত্য আর পুরোনো প্রেমের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করে, সেখান থেকে শুরু হয় মানসিক যাতনা।
১০. ফেসবুকের কারনে পড়তে পারেন আইনি জটিলতায়:
ফেসবুকে কমেন্ট আর শেয়ারের কারণে অনেক সময় তৈরি হয় আইনি জটিলতা। এই আইনি জটিলতায় মামলা–মোকদ্দমাসহ বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে পারেন ব্যবহারকারীরা, অপরাধের শিকার বা অপরাধী হিসেবে পরিচিতি পেতে পারেন যে কেউ।
১১. অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যাবহারের ফলে তৈরি করে আসক্তি:
অত্যধিক সময় ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে আসক্ত জন্মায়। মনে রাখতে হবে, মস্তিষ্কে আসক্তির এই চক্র আর অন্যান্য মাদকের আসক্তির চক্র একই। মাদকাসক্তিতে যে ধরনের শারীরিক বা মানসিক লক্ষণগুলো দেখা যায়, ফেসবুক আসক্তিতেও সেই ধরনের শারীরিক বা মানসিক লক্ষণ পাওয়া যায়—ক্ষতির পরিমাণও সমান। আর ফেসবুক আসক্তির কারণে ব্যক্তিগত, পেশাগত আর সামাজিক জীবন, সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে অন্যান্য মাদকে আসক্ত হওয়ার প্রবণতাও বেড়ে যেতে পারে।
১২. ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাস আর ম্যালওয়ারের বিস্তার:
ফেসবুকে বিজ্ঞাপন আর অচেনা লিংক থেকে ক্ষতিকর ভাইরাস আর ম্যালওয়ার আপনার মোবাইল আর ল্যাপটপে প্রবেশ করতে পারে। যা আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা থেকে শুরু করে মোবাইল বা ল্যাপটপকে নষ্ট করে ফেলে। কখনো ফেসবুক দিয়ে প্রবেশ করে কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ইত্যাদি হ্যাক করে ফেলতে পারে।
১৩. বাড়তে পাড়ে একাকিত্ব :
ফেসবুক একজন একাকী মানুষকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আরও একাকী করে ফেলে। এই একাকিত্ব থেকে হতাশা, বিষণ্নতা ইত্যাদি তৈরি হয়। সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। বিষণ্ন জীব হিসেবে বেঁচে থাকে বটে, কিন্তু মানবিক গুণাবলি বিবর্জিত হয়ে যায়।
১৪. মাত্রাতিরিক্রি ফেসবুকের ব্যাবহারে সৃষ্টি হয় শারীরিক সমস্যা:
ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি করে, ঘাড় ও মাথায় ব্যথা তৈরি করে। আবার বসে বসে বা শুয়ে শুয়ে ফেসবুক ব্যবহারের কারণে ওজন বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহার খাদ্যাভ্যাসের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়।
১৫. সৃষ্টি হয় আচরনগত সমস্যা:
ফেসবুক ব্যবহারের কারণে বিষণ্নতা আর অতি উদ্বিগ্নতা দেখা দেয়। মানুষ একাকী হয়ে পড়ে। আচরণে বৈকল্য দেখা দেয়। ফেসবুক থেকে আহরিত ভাষা চর্চার কারণে মুখের ভাষার পরিবর্তন হয়, আচার–ব্যবহারে উগ্রতা তৈরি হয়।
১৬. শরীরী ভাষার ব্যবহার কমে যাওয়া:
মানুষ উচ্চারিত আর অনুচ্চারিত দুভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে। বেশি বেশি সময় ফেসবুকে থাকতে থাকতে যোগাযোগ দক্ষতার ঘাটতি হয়—ননভারবাল ল্যাঙ্গুয়েজের (শরীরী ভাষা) ব্যবহার কমতে থাকে, যা দক্ষ যোগাযোগ ঘাটতির জন্ম দেয়।
১৭. সৃষ্টি হতে পারে যৌন সমস্যা:
ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তি যৌন সমস্যা তৈরি করে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। কখনো যৌন দুর্বলতা হতে পারে আবার কখনো বিকৃত ধরনের যৌন আচরণ দেখা দেয়।
১৮. রাত জেগে ফেসবুক ব্যাবহারে ঘুমের সমস্যা:
রাত জেগে ফেসবুক ব্যবহারের ফলে ঘুমের চক্রটি উল্টে যায়। রাতে জাগা আর দিনে ঘুমানোর অভ্যাস হয়। দিনের বেলা অফিসে বা ক্লাসে ঝিমুনি চলে আসে। ঘুমের সমস্যাটি ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভাব ফেলে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠে, আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
১৯. সামাজিক দক্ষতা কমে যাওয়া:
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ-গল্প আর আড্ডা মানুষকে সামাজিকভাবে দক্ষ করে তোলে। ফেসবুক নামেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রকৃতপক্ষে এটি মানুষকে সামাজিকতা বিমুখ করে তোলে। ফেসবুক আসক্তির কারণে আড্ডা, দাওয়াত এড়িয়ে মানুষ কেবল মুঠোফোনে মুখ গুঁজে থাকতে চায়। এতে করে সামাজিক দক্ষতা দারুণভাবে কমে যায়।
২০. পেশাগত বা একাডেমিক জীবনে সমস্যা:
ফেসবুকে সময় দেওয়ার কারণে অফিস বা ক্লাসে মনোযোগ কমতে থাকে। পড়ালেখা আর কাজের মান খারাপ হয়। বই পড়ার পরিমাণ কমে যায়, জ্ঞানচর্চার একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে ওঠে ফেসবুক। ঘুমের সমস্যার কারণে অফিস বা ক্লাসে ঠিকমতো হাজির হতে পারে না। ফলে পেশাগত বা একাডেমিক জীবনে সমস্যা তৈরি হয়।
২১. গুরুতর মানসিক রোগের লক্ষণ বেড়ে যাওয়া: যাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক রোগ রয়েছে—ফেসবুকের ব্যবহার তাদের সেই মানসিক রোগের লক্ষণ বাড়িয়ে দেয়। সন্দেহপ্রবণতা বেড়ে যায়, খুঁতখুঁতে স্বভাব বেড়ে যায়। যাদের গুরুতর মানসিক রোগ, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রয়েছে তাদের মধ্যে উগ্রতা, নিজেকে বড় মনে করা, সহিংসতা বাড়তে থাকে।
তার মানে কি ফেসবুকের কোনো ভালো দিক নেই? অবশ্যই আছে। এই ভালো দিকগুলো পেতে হলে ফেসবুকের ব্যবহার হতে হবে পরিমিত এবং যৌক্তিক; যা যাপিত জীবন আর পেশার ওপর কোনো ধরনের খারাপ প্রভাব ফেলবে না।
ঠিক বলেছেন। তবে ভেবেছিলাম অন্য আরও কিছু পাব। মোটামুটি জানা কথা সবগুলোই।