দূর্নীতি কি বাংলাদেশের দূর্নীতির কারন ও কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়
আমাদের আজকের বিষয় দূর্নীতি কি? (What is corruption) বাংলাদেশে দুর্নীতির কারন গুলো কি কি (What are the causes of corruption in Bangladesh) ও দূর্নীতি প্রতিরোধের উপায় (Ways to prevent corruption or How can we stop corruption) এবং কঠোর আইন ই পারে দুর্নীতি দমন করতে (Strict laws can curb corruption) এ সকল বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
দূর্নীতি কি? (What is Corruption): দূর্নীতি হলো মানুষের নৈতিকতা হতে বিচ্যুত হয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া। যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা। ঘুস গ্রহণ হতে শুরু করে স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোন অসামাজিক উপায় অবলম্বন করাই হলো দূর্নীতি।কোনো দেশকে একদম ভেতর থেকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য যুদ্ধ, খরা, অর্থ সংকট এসব কিছুই দরকার নেই, চরম দুর্নীতি থাকলেই যথেষ্ট।
সমাজের এক ভয়ানক ব্যাধি এই দুর্নীতি। এই দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে দুর্নীতি এক ভয়াবহ জাল বিস্তার করেছে। এই স্বাধীন বাংলায় পরাধীনতার পতাকাও উত্তোলিত হয়েছিল মীর জাফর, মীর কাশেম এবং জগৎশেঠ দের দুর্নীতি এবং বিশ্বাস ঘাতকরা মধ্য দিয়ে। লজ্জাজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা এখনো আমরা আমাদের নিজেদের দুর্নীতি মুক্ত করতে পারি নি। এখনো আমাদের প্রতিটি খাত দুর্নীতির জালে জর্জরিত।
(Transparency International) "টিআই" দূর্নীতিবাজ দেশ গুলোর উপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতি গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেকগুন বেড়ে গিয়েছে ৷ গত বছরের তুলনায় এবার চার ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের৷
টিআই-এর সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া এবং সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ডেনমার্ক৷ বাংলাদেশ, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও উগান্ডা এই তিনটি দেশ দুর্নীতিতে সমান অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের বেসরকারী দুর্নীতি দমন সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা (টিআইবি) থেকে ২০১৮ সালে ঢাকায় দুর্নীতির ধারণা সূচক সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চলমান দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে ।
টিআই ১৮০ টি দেশের ওপর চালানো ওই জরিপে ০ থেকে ১০০ নাম্বরের স্কেলে দেশগুলোকে নাম্বার দেয়া হয়৷ যেই দেশের স্কোর সবচেয়ে কম হয় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তার অবস্থান থাকে শীর্ষে৷ যার স্কোর কম তার অবস্থান হয় সবচেয়ে নিচে অর্থাৎ ওই দেশ সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ।যেমন সোমালিয়ার স্কোর সবচেয়ে কম (১০)৷ তাই দুর্নীতির ধারণা সূচকে সোমালিয়া এবার সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ৷ তেমনি সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্কের স্কোর ৮৮৷ বাংলাদেশের স্কোর ২৬ অর্থাৎ দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান বেশ উপরে।
টিআই'র দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ তালিকার এক নম্বরে ছিল। অর্থাৎ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল৷ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ১৩তম , ২০১০ সালে ১২তম , ২০১১ সালে ১৩তম , ২০১২ সালে ১৩তম , ২০১৩ সালে ১৬তম, ২০১৪ সালে ১৪তম , ২০১৫ সালে ১৩তম, ২০১৬ সালে ১৫তম, ২০১৭ সালে ১৭তম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ১৩তম অবস্থান লাভ করে। এই সমীক্ষা থেকে একটি জিনিস প্রতীয়মান হয়, দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান সব সময়ই উল্লেখযোগ্য অবস্থায় ছিল যা আমাদের জন্য খুবই হতাশা জনক।
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের এক প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশে ভূমি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই তিন খাতে দুর্নীতি ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি যে কি পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে তার সবচেয়ে বড় প্রমান আমরা এই করোনা কালে দেখতে পেয়েছি। করোনা টেষ্ট এর নামে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রেজিস্ট্রার ভুক্ত ডাক্তাররা। যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে হাসপাতাল, নার্সিংহোম। অঃকটু টাকা খরচ করলেই মিলছে বৈধতা। স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয় সব জেনেও না জানার ভান করে আছে । সরকারী নিয়ম মাফিক করোনা টেষ্ট ফি ২০০টাকা ধার্য করে দিলেও হাসপাতাল গুলো এই নিয়ম না মেনে ইচ্ছেমত ফি নিচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয় সব জেনেও নির্বিকার।
শিক্ষা খাতে এই দুর্নীতি আরো ভয়াবহ। ভর্তি জালিয়াতি, প্রশ্ন পত্র ফাঁস, ভর্তি বানিজ্য এখন যেন সাধারন ঘটনা হয়ে গিয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করলেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন কেনা যাচ্ছে, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। যার ফলে অযোগ্য রা যোগ্যদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে।
তবে অবাক ব্যাপার হল দুর্নীতি বাড়লেও এর বিরুদ্ধে অভিযোগ কমে গেছে।দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এক শীর্ষ গণমাধ্যমে বলেছেন, তদন্তের মান এবং সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, সেটাই মামলা কমে যাবার কারণ।
কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা এই কথার উল্টো অভিযোগ করেছেন যে, "রাজনৈতিক বিবেচনার প্রশ্ন আছে, এমন বড় বড় ইস্যু এড়িয়ে গিয়ে দুদক ছোটখাটো বিষয়ে মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে।"এর বিপরীতে দুদক বলছে, সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের জীবনে যে দুর্নীতি বা অনিয়মের মুখোমুখি হচ্ছে, তা প্রতিরোধের বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
টিআইবি প্রধান "ড. ইফতেখারুজ্জামান" এক সম্মেলনে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় কারন ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন- উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বিচারের আওতায় না আসা, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি আরো বলেন ২০১৭ সালের চেয়ে আরো চার ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে ।
বেড়ে যাওয়ায় কারন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেসব কারণে আমাদের ফল ভালো হয়নি , তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে আমাদের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার থাকে, রাজনৈতিক ঘোষণা থাকে, কিন্তু সেটার বাস্তব প্রয়োগ হয় না। উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় বা (তেমন) দৃষ্টান্ত রয়েছে। অবৈধ অর্থ পাচারের যে বিষয়টি, সেটি অবশ্যই এই সূচকে বিবেচিত হয়ে থাকতে পারে।’
এর প্রতিরোধ সম্পর্কে তিনি বলেন- "এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, দুর্নীতি করলে যে শাস্তি পেতে হয়, সেটি নিশ্চিত করা। যারা দুর্নীতি করবে, উচ্চ পর্যায়েরই হোক, যেই পর্যায়েরই হোক না কেন, যেন তারা আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতি উপভোগ করবেন, সেটি যেন না হয়।" কঠোর শাস্তিই পারে দূর্নীতি প্রতিরোধ করতে এবং একটি সুস্থ সমাজ উপহার দিতে!
দুর্নীতি দমন করার দায় শুধু সরকারের একার নয়। আমরা প্রতিটি মানুষ যদি নিজেদের জায়গা থেকে নিজেদের সচেতন ও দুর্নীতি মুক্ত রাখি তবেই এই দুর্নীতি প্রতিরোধ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা তৈরী করা যাবে।