রচনা: বাংলাদেশে নারীর অধিকার
রচনা: বাংলাদেশে নারীর অধিকার
অথবা, উন্নয়নে নারীর অবদান
(সংকেত: ভূমিকা- নারীসত্তার স্বরুপ- বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী অধিকার চিত্র- নারীর অধিকার সংরক্ষণে সরকারের ভূমিকা- বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী উন্নয়নের সমস্যা - উপসংহার)
ভূমিকা: ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।'–জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত উক্তি। মানব জাতির অর্ধেকই নারী। সুতরাং মানবীয় উৎপাদন এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ সমান সমানই হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে এ অবস্থা অনুপস্থিত ছিল বহু বছর পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে বিশেষত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন সূচিত হয়। সাম্প্রতিককালে গােটা বিশ্বেই নারীর উত্থান, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ এবং সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নারীর অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে নীতি নির্ধারক মহলের মনােযােগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
নারীসত্তার স্বরূপ: আমরা জানি যে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। এ পার্থক্য শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নয়, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকও। এমনকি সামাজিক ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা পৃথক। এ কারণে সাম্প্রতিককালেও লিঙ্গ (Sex) এবং জেন্ডার (Gender) আলাদা ভাবে প্রয়ােগ করা হয়। লিঙ্গ দ্বারা প্রাকৃতিক বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য নির্দেশ করা হয় এবং আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারী যে আলাদা সত্তা তা জেন্ডার দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এরপরেও নারী-পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত নতুন একটি ধারণা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। একে নারী ক্ষমতায়ন (Women Enpowerment) নামে অভিহিত করা হয়। এ ধারণায় সম্পদের ওপর নারীর অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নারী-পুরুষের সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সমতা বিধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী অধিকার চিত্র : অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাের মতাে বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর সার্বিক অবস্থান পুরুষের তুলনায় নিম্নস্তরে। আর্থসামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের বৈষম্যের চিত্র প্রকট। একই ভাবে পারিবারিক স্তর থেকে আরম্ভ করে জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান। তাছাড়া বৃহত্তর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা অনুল্লেখ যােগ্য। ৭০ দশকের পূর্বে এদেশে নারী বিষয়ক স্বতন্ত্র আলােচনা-পর্যালােচনা বা সচেতনতাও তেমন ছিল না, যদিও এ শতকের গােড়ার দিকে বেগম রােকেয়া নারীর বনা সম্পর্কে লিখেছেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে নারীরা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এদেশে নারী উন্নয়নের পদক্ষেপ শুরু হয়। ১৯৭২ সালে মহিলা পুনর্বাসন কল্যাণ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হয়। তারপর ১৯৭৮ সালে মহিলাবিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়। এরপর ৮০-র দশক থেকেই বাংলাদেশে নারী জাগরণ প্রসার লাভ করে। বাংলাদেশের নারীদের অধিকারের চিত্র নিম্নরূপ :
ক)অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে: বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর থান মূলত গৃহে। গৃহস্থালি কাজকর্মই নারীদের প্রধান কাজ। সরকারি পরিসংখ্যানে নারীর এরূপ উৎপাদনমুখী কাজের কোনাে স্বীকৃতি নেই। কারণ নারী এ কাজে কোনাে বিনিময় মূল্য পায় না। BBS এর তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৯% এবং এর ৮০% গ্রামে এবং ২০% শহরে নিয়ােজিত।সরকারের বিভিন্ন চাকরিতে মহিলাদের জন্য কোটা প্রবর্তনের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।
খ)সামাজিক ক্ষেত্রে: সামাজিক প্রথা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী এদেশের নারীসমাজ নানা বঞ্চনা এবং নিপীড়নের শিকার হয়। এর মধ্যে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক, শ্রম বিভাজন, সামাজিক বিধি-নিষেধ, সম্পদের ওপর অসম অধিকার এবং স্বাধিকার থেকে বঞিত ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
গ) স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে: বাংলাদেশে নারী শিক্ষা বরাবরই অবহেলিত। তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার সুযােগ খুবই কম। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ও এখানে একই চিত্র নিহিত। অর্থাৎ, সার্বিক ভাবেই নারীরা অধিকার বঞ্চিত।
ঘ) আইন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে: বাংলাদেশে সরকার ও বিরােধী দলের প্রধান নারী হলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা তেমন উল্লেখযােগ্য নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান ভােটাধিকার দেওয়া হলেও বাস্তবে ভােটদানের সিদ্ধান্ত পুরুষই নারীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে থাকে। তাছাড়া সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ, পরিবার ও সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে এদেশে নারী অধিকার যৎসামান্য। যেমন : হিন্দু আইনে নারী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না; মুসলিম ও হিন্দু উভয় আইনে সন্তানের অভিভাবক পিতা; মুসলিম আইনে ছেলে ও মেয়ে সন্তান সমান উত্তরাধিকার ভােগ করে না। অন্যদিকে হিন্দু নারীর তালাক দেওয়ারও অধিকার নেই।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে নারীরা সর্বক্ষেত্রেই কোনাে না কোনাে ভাবে অধিকার বঞ্চিত। আর এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার নারীর উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কারণ সরকার উপলব্ধি করতে পারছে নারীকে বাদ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
নারীর অধিকার সংরক্ষণে সরকারের ভূমিকা: বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার নারী উন্নয়নের স্বার্থে যুগােপযােগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।নারীদের সচেতন করার জন্য বিভিন্নভাবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করেছে। তাছাড়া নারী উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের বেতার ও টেলিভিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদসহ বিভিন্ন আইনি সংস্থা নারীর অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নারী উন্নয়নে সমস্যা: কথায় আছে, “অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করতে হয়। বাংলাদেশের নারীদেরকে এ স্লোগানে শপথ নিয়ে সামনে এগুতে হবে। এজন্য দরকার নারীশিক্ষা। তাই নারীদেরকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে যাতে তারা নিজের অধিকার নিজেই আদায় করতে পারে। তাছাড়া নারীদের মানসিক দাসত্ব মনােভাব পরিহার করতে হবে। তাহলেই কেবল সম্ভব নারীদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা।
উপসংহার: বাংলাদেশে নারীরা এখন প্রায় স্বাধীনভাবে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভােগ করতে পারছে না। তবে সার্বিক বিবেচনায় বর্তমানে নারী সমাজ দ্রুত উন্নতির পথে এগুচ্ছে; যা ভবিষ্যতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।