মুঘল সম্রাটদের কথকথা
মুঘল সাম্রাজ্য! এই ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যের নাম শুনে মানুষ এখনো শিহরিত হয়। এমনকি যে ব্যক্তি ইতিহাস সম্পর্কে একদম নেই তিনিও সেই হারানো সময়টিতে উঁকি দিতে চান।
"মোঘল সম্রাটদের কথকথা" এই নিবন্ধে, আমি আপনাকে মুঘল সাম্রাজ্যের সেই সব শাসকদের সাথে আবার পরিচয় করাবে যারা সময়ের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছেন। আলোচনা করবো মুঘল সম্রাটদের আত্মজীবনী বলব সেই সব সম্রাটদের সম্পর্কে বলি যারা বছরের পর বছর এই হিন্দুস্তান শাসন করে ছিলেন। এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়। এটি ইতিহাসের এক যাত্রা। এই যাত্রায় সবাইকে স্বাগতম।
১. জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর(১৫২৬-১৫৩০):
মুঘল সামাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ১৪৮৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্য এশিয়ার বর্তমান উজবেকিস্তানের ফরগনা রাজ্যে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন ফরগনা রাজ্যের অধিপতি। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবর ফরগনা রাজ্যের সিংহাসন গ্রহণ করেন।
সাহসিকতা ও নির্ভীকতার জন্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি ‘বাবর’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি পিতার দিক থেকে তৈমুর লঙ এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন।
‘তুযক-ই-বাবুর’ বা বাবুরের আত্মজীবনী নামক গ্রন্থে বাবুর তাঁর জীবনের জয়পরাজয়ের ইতিহাস অতি সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাবরের সবচেয়ে ভাল গুন হল তিনি খুব দৃঢ় স্পৃহা ছিল।
তিনি তার প্রথম স্ত্রী সালতান বেগমের কাছে কিছুটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন ।যদিও পরে তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বাবর তার আত্মজীবনী গ্রন্থে কিশোর বয়সের কামনা "বাবুরী" নামক এক বালকের সম্পর্কে বেশ গুরুত্বের সাথে ব্যাখ্যা করেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের এই প্রতিষ্ঠাতা বেশী দিন তার সামাজ্য শাসন করতে পারেন নি। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ বছর পর ১৫৩০ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সম্রাট জহির উদ্দিন বা বাবর মৃত্যুবরণ করেন।
২. সম্রাট হুমায়ুন (১৫৩০- ১৫৪০ খ্রি.) :
মুঘল সম্রাট বাবুরের মৃত্যুর পর তার পুত্র হুমায়ুন মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। দেশ পরিচালনায় তিনি তাঁর বাবাকে সহায়তা করেছিলেন। তাই রাজ্য শাসনের জ্ঞান তার বেশ ভালই ছিল।
১৫২০ সালে, মাত্র ১২ বছর বয়সে হুমায়ূন রাজ্যপাল নিযুক্ত হন। ১৫২৬ সালে বাবর যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন তখন হুমায়ূন তাঁর সাথে বাদশা থেকে একটি দল নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
এই প্রচারণায় হুমায়ূন প্রথম বিজয় অর্জন করেছিলেন। তিনি কান্নাহার যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন আফগান বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে তাঁর বাবার শাসনে প্রতক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৫৩০ সালে তার পিতা বাবরের মৃত্যুর পরে, তিনি তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে নির্বাচিত হন
১৫৩৯ সালে চৌরাসির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হুমায়ুন কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে দিল্লি পৌছেন। শেরশাহের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিচার করতে না পারার ফলস্বরূপ হুমায়ুন ১৫৪০ সালে কানৌজের যুদ্ধে পরাজিত হন।
তিনি পলাতক হয়ে সিন্ধু হয়ে ইরানের দিকে পালিয়ে যান। পরর্তীতে পারস্যের সম্রাটের সহায়তায় হুমায়ুন ১৫৫৫ সালে পুনরায় দিল্লি দখল করেন।
তার পিতার মত তিনিও বেশী দিন সাম্রাজ্য ভোগ করতে পারেন নি।তিনি ১৫৫৬ সালে দিল্লির অদূরে তাঁরই নির্মিত দীন পানাহ দূর্গের পাঠাগারের সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.):
সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর সিংহাসন দখল করে করেন তার পুত্র আকবর । মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৫৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি এই সিংহাসনের অধিপতি হন।
আকবর The Great কে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট।
ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক অবস্থা স্থীতিশীল করার লক্ষ্যে তিনি প্রথম আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থাপন করেন। অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও তিনি মনোযোগ ছিলেন ।
তিনি মুঘলদের প্রধানতম প্রতিদন্ধী রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এক রাজপুত নারীকে বিবাহ করেন। এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্য এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় সীমানার অদিবাসী হয়।
সম্রাট আকবর তার জীবন কালের শেষ পর্যায়ে ইসলাম ত্যাগ করেন এবং দ্বীন-ই-ইলাহি নামে নতুন এক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধর্মের মাত্র ১৮ জন অনুসারিী।
সম্রাট আকবরের সময়ই মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বিকশিত ছিল আর এজন্য তাকে শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট হিসেবে বিবেচসা করা হয়। ১৬০৫ সালে সম্রাট আকবর মৃত্যুবরন করেন।
৪. সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭ খ্রি.):
মুঘল সাম্রাজ্যের ৪র্থ সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৫ থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করেন। মাদক ও নারীতে আসক্ত সম্রাট জাহাঙ্গীর শাসন আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের ভীত কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে।
তবে তার আমলেই সমগ্র বাংলা অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলার রাজধানী বিহারের রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন।
তিনি সরকারি কাজে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ফর্সি ভাষা প্রচলন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬২৭ সালে মৃতুবরন করেন।
৫. সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি.)
সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান ১৬২৮ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের ৫ম সম্রাট হিসেবে দিল্লীর সিংহাসন আরোহন করেন। সম্রাট শাহজাহান এর আমলকে মুঘল শাসন আমলের স্বর্নযুগ বলে অভিহিত করা হয়।
শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে সম্রাট শাহজাহানের পৃষ্টপোষকতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে Prince of Builder হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্যে শিল্প সংস্কৃতির অনেক বিকাশ সাধিত হয়েছিল।
মমতাজ ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের ১৪তম স্ত্রী। সম্রট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে যমুনা নদীর তীরে বিখ্যাত তাজমহল নির্মান করেন।
সম্রাট শাহজাহানের অমর সৃষ্টি হচ্ছে: কোহিনুর হীরা ও মণি মুক্তা খচিত ময়ুর সিংহাসন। সম্রাট শাহজাহান দিল্লিতে লাল কেল্লা, জাম-ই-মসজিদ, দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস, আগ্রায় মতি মসজিদ এবং লাহোরে সালিমার উদ্যান নির্মাণ করেন।
সম্রাট শাহজাহানের শেষ জীবন অত্যন্ত করুন অবস্থায় কাটে। ৪ পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য নিয়ে মনোমালিন্যের রেশ ধরে পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে গৃহবন্দী করেন। ১৬৬৬ সালে সম্রাট শাহজাহান আগ্রা দুর্গে বন্দী থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন।
৬. সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.):
সম্রাট আওরঙ্গজেব শাসনামলে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে আবর্ভুতহয়। প্রায় ৪৯ বছরের শাসনামলে অন্তত দৃঢ়তার সাথে মুঘল সামাজ্য পরিচালনা করেন।
তার শাসন আমলে বিধর্মীদের উপর জিজিরা কর প্রথা চালু হয়। সহজ সরল জীবন-যপন ও ইসলামি শরীয়ত অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য তিনি জিন্দাপীর হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন।
৭. সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৮৩৭-১৮৫৭ খ্রি.)
সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট ।তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য দূর্বল হতে হতে একদম শেষ হয়ে যায়। সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুনে) নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৮৬২ সালে তিনি রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এবং রেঙ্গুনেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, "ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্তি হয়"। মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থ, আভিজাত্য , শক্তি থাকার পরও সময়ের কাছে তারা পরাজিত। সময়ের গহ্বরে তাদের হারিয়ে যেতেই হয়েছে। তাদের ঐশ্বর্য , বীর্য কোনো কিছুই তাদের এই পতনের আহত থেকে রক্ষা করতে পারে নি।