অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা রচনা

রচনা: অর্থনৈতিক উন্নয়নে যােগাযােগ ব্যবস্থা
অথবা, বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা

(সংকেত: ভূমিকা–যােগাযােগ ব্যবস্থা - বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার চিত্র - অর্থনৈতিক উন্নয়নে এদের গুরুত্ব - উপসংহার)
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা

ভূমিকা : উন্নয়ন একটি বহুমুখী ও ব্যাপক প্রক্রিয়া। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। যে দেশের পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা যত উন্নত সেই দেশের অর্থনীতিও তত উন্নত। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক প্রভৃতি দিক থেকে বিচার করলেই দেশের পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

যােগাযােগ ব্যবস্থা: যােগাযােগ ব্যবস্থা বলতে মূলত পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থাকে বােঝায়। ইদানীং পরিবহন এবং যােগাযােগ ব্যবস্থাকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হয়। পরিবহন ব্যবস্থার আওতাভুক্ত বিষয়গুলাে হচ্ছে স্থল পরিবহন, জল পরিবহন এবং আকাশ পরিবহন। আর যােগাযােগ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত বিষয়গুলাে হচ্ছে- (ক) ডাক বিভাগ, (খ) তার বিভাগ, (গ) টেলিফোন, (ঘ) বেতার, (ঙ) টেলিভিশন, (চ) কম্পিউটার, (ছ) ভূ-উপগ্রহ।

বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার চিত্র: স্বাধীনতার তিন দশক অতিক্রান্ত হলেও এদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা এখনও ততটা উন্নত নয়। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে স্থাপিত অধিকাংশ স্থাপনা নিয়ে এদেশটি এখনও সার্বিক যােগাযােগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। নিচে বাংলাদেশের বর্তমান যােগাযােগ ব্যবস্থার চিত্র সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলাে :

ক) ডাক বিভাগ: এদেশের প্রধান যােগাযােগ মাধ্যম হিসেবে এখনও ডাক ব্যবস্থা প্রচলিত। ডাক বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মধ্যে চিঠিপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র আদান-প্রদান এবং অর্থের লেনদেন সম্পন্ন হয়ে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাংলাদেশে ডাকঘরের মােট সংখ্যা ছিল মাত্র ২০০০। সাবেক পাকিস্তান আমলে ডাকঘরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬০০০ হয়। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এসব ডাকঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের জরুরি পদক্ষেপের কারণে ডাক বিভাগ পুনরায় সচল হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশে মােট ডাকঘরের সংখ্যা ছিল ৬৬৮০টি। পরবর্তীতে ডাকঘরের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ডাক ব্যবস্থাকে আধুনিক করার জন্য ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ পােস্ট কোড চালু করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১টি কেন্দ্রীয়, ৪টি বিভাগীয়, ৭০টি প্রধান পােস্ট অফিস, ১৫৪৯টি সাব-পােস্ট অফিস এবং ৫৯৭১টি শাখা পােস্ট অফিস সহ মােট ৮১৩২টি পােস্ট অফিস রয়েছে। পােস্ট অফিসের সেবার মান আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যা অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। ১৯৯৮/৯৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী মােট ডাকঘরের সংখ্যা ৯৩৩৬টি।

খ) তার বিভাগ: বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিস সহ সর্বমােট ৮৫৬টি টেলিগ্রাফ অফিস আছে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে এর ব্যবহার হ্রাস পেলেও বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থায় এর ভূমিকা এখনও ব্যাপক।

গ) টেলিফোন: বাংলাদেশ টেলিফোনখাতে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। সারা দেশের অধিকাংশ জেলাই এখন ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। তাছাড়া প্রতিটি থানাকেও এ ব্যবস্থায় আনার কাজ পুরােদমে এগিয়ে চলেছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে টেলিফোন সংযােগের সংখ্যা দাঁড়ায় ২,৯৫,৯৮২টি। বর্তমানে এ সংখ্যা ৪ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া মােবাইল ফোন বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। গ্রামীণ ফোন, সিটিসেল, একটেল, সেবা, বাংলালিংক, ওয়ারিদ প্রভৃতি কোম্পানি ব্যাপক ভাবে তাদের গ্রাহকসংখ্যা বাড়াচ্ছে। মােবাইল ফোন চালু হবার পর থেকে দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা অনেক সহজতর হয়েছে।

ঘ) বেতার: বাংলাদেশের অন্যতম যােগাযােগ ব্যবস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ বেতার । ১৯৪৭ সালে এদেশে ১টি মাত্র বেতার কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীকালে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে ১০ কিলাে ওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বিশিষ্ট একটি করে ট্রান্সমিটার এবং সিলেটে ২ কিলােওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ বিশিষ্ট একটি ট্রান্সমিটার বসানাে হয়। ১৯৬১ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে ১০০ কিলােওয়াট শক্তিসম্পন্ন। একটি নতুন ট্রান্সমিটার বসানাে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বে খুলনা ও চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ সরকার দেশের ক্ষতিগ্রস্ত বেতার কেন্দ্রগুলাের সংস্কার করে। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, রংপুর, খুলনা, রাঙামাটি, কুমিল্লা ও ঠাকুরগাঁওতে বেতার কেন্দ্র রয়েছে। সংবাদ প্রচার ছাড়াও বাংলাদেশ বেতার বিভিন্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিত্তবিনােদন এবং তথ্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। দেশের জনসাধারণকে উন্নয়নমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশ গঠনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি যথা : গণশিক্ষা কার্যক্রম, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কার্যক্রম, কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, মহিলা বিষয়ক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়মিত প্রচার করা হয়।

ঙ) টেলিভিশন: ১৯৬৪ সালে DIT ভবনে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সালে এটি রামপুরায় নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৮০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন রঙিন চিত্র প্রদর্শনী শুরু করে। বর্তমানে ১৬টি রিলে স্টেশন মারফত টেলিভিশন সারা দেশে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। তাছাড়া বর্তমানে ক্যাবল লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন নতুন নতুন চ্যানেলের অনুষ্ঠান আমরা দেখতে পাচ্ছি। জনপ্রিয় চ্যানেলগুলাে হলাে- এটিএন, চ্যানেল আই, চ্যানেল ওয়ান, বাংলাভিশন, এনটিভি, বৈশাখী, একুশে প্রভৃতি। টেলিভিশন সংবাদ প্রচার ছাড়াও নিয়মিত চিত্তবিনােদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। এছাড়া শিশু শিক্ষা ও যুবকল্যাণ অনুষ্ঠান, মহিলা বিষয়ক অনুষ্ঠান, কৃষি সংক্রান্ত অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে এক সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

চ) কম্পিউটার: বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ। তাই কম্পিউটার ই-মেইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যােগাযােগ ব্যবস্থাকে অত্যন্ত সহজ। করে দিয়েছে। তাছাড়া FAX ব্যবস্থাও যােগাযােগে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

ছ) ভূ-উপগ্রহ: বহির্বিশ্বের সাথে যােগাযােগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলাে ভূ-উপগ্রহ। মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলন করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সংবাদ প্রেরণ করা যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে এদের গুরুত্ব: বর্তমানে একটি দেশের অর্থনীতি যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সহজ যােগাযােগ ব্যবস্থা ছাড়া ব্যবসায়িক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে কোনাে কার্যক্রমই চালানাে সম্ভব নয়। যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর দেশের বিনিয়ােগ
নির্ভরশীল। তাছাড়া এ বিশ্ব-বাণিজ্যের যুগে কোনাে কাজই যােগাযােগ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে সম্ভব নয়। যােগাযােগ ব্যবস্থার অন্যতম সহযােগী হিসেবে E-Commerce এখন বিশ্বখ্যাত। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তাই যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আরাে বিস্তৃতভাবে দরকার। তাছাড়া যােগাযােগ ব্যবস্থা একটি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে। যথা : (ক) অর্থনৈতিকউন্নয়নে, (খ) বাজার ব্যবস্থার উন্নতিতে, (গ) সম্পদের সুষম বণ্টনে   সহযােগিতা ইত্যাদি।

উপসংহার: একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যােগাযােগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সার্বিক যােগাযােগ ব্যবস্থা এখনও শহরকেন্দ্রিক। তাই দেশের প্রায় ৭০% মানুষ এখনও আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এজন্য এখনই জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়ােজন। মনে রাখতে হবে উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত অর্থনীতির পূর্বশর্ত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url