রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ রহস্য এবং ইতিহাস
ভানগড় দূর্গ- ইতিহাস, ঐতিহ্য, রহস্য সব মিলিয়ে এক রোমান্ঞ্চকর জায়গা। মৃত্যুর নিস্তব্ধতা এবং প্রকৃতির নিরব সৌন্দর্য এখানে একসাথে বসবাস করে। এখানে প্রকৃতি যেন এক মায়াজাল বিছিয়ে রেখেছে। যে একবার এখানে যায় সেই ওই মায়াজালে আটকে যায়। সেই কবে কোন রাজা এই দূর্গ তৈরী করে গেছেন। কালের অমোঘ নিয়মে সেই দূর্গ ধ্বংস স্তূপ এ পরিনত হয়েছে কিন্তু রহস্য প্রিয় কাছে এই দূর্গের আবেদন এখনো এতটুকু কমেনি।
সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিং এর ছোট ভাই মাধো সিং সপ্তদশ শতাব্দীতে এই প্রাচীন দূর্গটি নির্মান করেন। ভারতের রাজস্থানের ভানগড় শহরে তৈরি করা হয় বলে একে ভানগড় দূর্গ নামে অভিহিত করা হয়।
কেমন ছিল সেই ভানগড়?
প্রাচীন দূর্গটি বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলেও এর আভিজাত্যের চিহ্ন এখনও পাওয়া যায় । কেল্লায় ঢুকতে গিয়েই চোখে পড়ে প্রায় 30ফুট উঁচু দরজা।
দরজা দিয়ে ঢুকদেই চোখে পড়বে ভগ্ন বাগান। বাগান পেরিয়ে সামনে গেলেই দেখা যায় একটি জলাধার। একে স্থানীয় ভাষায় ‘বউলি’ বলা হয়৷
প্রাচীন কালে এই দূর্গটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত। প্রাচীর এর ভিতরে থাকত ধনী এবং সরকারী কর্মচারীরা। দূর্গের বাইরে থাকত সাধারন প্রজারা। মূলত শত্রুদের আক্রমণ থেকে দূর্গ রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হত।
কোনো এক অজানা কারনে এই দূর্গের কাছাকাছি কোনো জনপদ নেই। সবার মনেই এই দূর্গটি নিয়ে এক অজানা আতঙ্ক।
জনশ্রুতি আছে যে,এই দূর্গ থেকে থেকে কোনো শব্দ নাকি বাইরে যেতে পারে না। শব্দের ধ্বনি এই এলাকার মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়।
যদিও এই দূর্গে রাত কাটানো অনেকে এই দূর্গ থেকে নূপুরের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
দূর্গ ধ্বংসের আশ্চর্য উপাখ্যান:
সাধুর অভিশাপ:
কথিত আছে মাধু সিং যখন প্রথম তার কেল্লা নির্মানের জন্য জায়গা তৈরি করছিলেন,তখন সেই কেল্লার চত্বরের এককোণেই ছিল সাধু বালুনাথের আশ্রম। তিনি এই কেল্লা তৈরিতে বাঁধ সাধলেন।
তিনি মাধু সিংকে বলেছিলেন, " রাজা কেল্লা বানাচ্ছেন তাতে তার আপত্তি নেই। তবে কেল্লার ছায়া যেন তার আশ্রমের উপর না পড়ে। ছায়া পড়লে তিনি মাধু সিংয়ের এই সাধের কেল্লা ধ্বংস করে দেবেন। এমনকি রাজবংশের কেউকে তিনি বেঁচেও থাকতে দেবেন না!"
মাধু সিং তখন সাধুর কথা মেনে নিলেও পরে তিনি সাধুর কথা অমান্য করেছিলেন। দেখা গেলো দিনের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও কেল্লার ছায়া সাধুর আশ্রমে পড়ত।
এতে সিধু ভীষন ক্ষুব্ধ হন অভিশাপ দেন। যার ফলে ধ্বংস হয় ভানগড়।
সুন্দরী রাজকন্যা ও এক ব্যর্থ তান্ত্রিক:
এই কেল্লা নিয়ে আর একটি কাহিনী হল রাজকন্যা রত্নাবতীর এবং তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া। বহুকাল আগে এই দূর্গের কছাকাছি এক জায়গায় তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া বসবাস করত।
ভানগড়ের রাজকন্যা রত্নাবলী প্রেমে সে ছিল পাগল। সিঙ্ঘিয়া ভালো করে জানত রাজকুমারীর সামনে যাওয়ার মত যোগ্যতা তার নেই। রাজকুমারীও তার আবেদনে কখনো সারা দেবে না।
তাই তান্ত্রিক এক ভিন্ন পথ অবলম্বন করল। সে রাজকুমারী কে বশীকরণ করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল।
একদিন রাজকুমারী রত্নাবতী তার দাসীদের নিয়ে বাজারে সুগন্ধী কিনতে গিয়েছিলেন। রাজকুমারী সুগন্ধি খুবই পছন্দ করতেন ।
তান্ত্রিক এই কথা জানত। তাই সে সুগন্ধীর উপর জাদু বিদ্যা করে। সিঙ্গিয়া ভেবেছিল , রাজকুমারী এই গন্ধ শুঁকে বশীভূত হবেন এবং সিঙ্ঘিয়ার পিছনে পিছনে চলে আসবেন।
কিন্তু রাজকুমারী রত্নাবতীর বুদ্ধিও কম ছিল না৷ তিনি এই ছল বুঝতে পেরে সুগন্ধীর বোতল একটি পাথরে ছুঁড়ে মারেন।
জাদুর প্রভাবে ওই পাথরটি বশীভূত হয়ে পড়ে এবং তান্ত্রিকের পিছনে ছুটতে আরম্ভ করে। ফলে ওই পাথরের তলায় চাপা পড়েই সিঙ্ঘিয়া মারা যায়।
তবে মরার পূর্বে সে রাজকুমারীকে অভিশাপ দিয়েছিল যে, "রাজপরিবারের কাউকে সে বাঁচতে দেবে না, আর রাজকুমারীকে সে মরার পরেও ছাড়বে না"।
এই ঘটনার ঠিক কিছুদিনের মধ্যেই ভানগড়ের সঙ্গে তাদের প্রতিবেশী রাজ্য আজবগড়ের যুদ্ধ লাগে। সিঙ্ঘিয়ার অভিশাপ যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করল।
ভানগড়ের মানুষ সাহসীকতার সাথে লড়াই করেছিল ঠিকই কিন্তু আজবগড়ের সৈন্যদের হাতে সবাই প্রান হারিয়েছিল। সেই যুদ্ধে রাজকন্যা নিজেও অংশ নিয়েছিলেন এবং ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন।
সেই যুদ্ধে গোটা ভানগড় যেন ধ্বংস স্তুপ হয়ে যায়। স্থানীয়দের মতে ওই কেল্লায় এখনো তান্ত্রিক ও রত্নাবতীর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেরোয়।
এটাও বিশ্বাস করা হয় রাজকন্যা এবং তান্ত্রিকের সাথে ভানগড়ের অসংখ্য মানুষের আত্মাও এই কেল্লায় এখনো বিরাজমান। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে থাকে সেই আত্মার দল এখনও ভানগড়কে পাহারা দিচ্ছে ।
স্থানীয়রা বিশ্বাস করে রাজকুমারী রত্নাবতী একদিন পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসবেন এই দুর্গে। সেদিন তার হাতে ভানগড়ের শাসনভার ফিরিয়ে দিয়ে তবে সেই অতৃপ্ত আত্মাদের তাদের মুক্তি হবে।
এরপর কেটে গেছে কয়েক শতাব্দী । ভানগড় এখনো দাড়িয়ে আছে তার সেই শীতল, হিংস্র এবং পরিত্যক্ত চেহারা নিয়ে। ভানগড় দূর্গ এবং তার আশেপাশের এলাকা অভিশপ্ত হিসেবে পরিচিতি পায় সারা ভারত তথা বিশ্বজুড়ে । দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটকের আগমন হয় এখানে। অনেকেই এখানে negetive energy অস্তিত্ব পেয়েছেন বলে দাবি করেন।