রচনা: সােয়াইন ফ্লু ও তার প্রতিকার

রচনা: সােয়াইন ফ্লু ও তার প্রতিকার

(ভূমিকা - সােয়াইন ফ্লু কী - সােয়াইন ফুর প্রকারভেদ - সােয়াইন ফ্লু'র ইতিহাস - সােয়াইন ফ্লু'র প্রসারণ - সােয়াইন ফ্লু'র লক্ষণ - ভাইরাস প্রতিরােধে প্রতিষেধক - সােয়াইন ফ্লু প্রতিকারের উপায় - সােয়াইন ফ্লু'র চিকিৎসা সােয়াইন ফ্লু ও বাংলাদেশ - সােয়াইন ফ্লু'র অন্যান্য তথ্য - উপসংহার)


ভূমিকা: আমাদের প্রিয় ধরণীতে প্রায় সাতশ কোটি মানুষের বসবাস। বিজ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে মানুষ মুক্তি পাচ্ছে জটিল সব রােগ থেকে। কিন্তু এর সাথে সাথে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন রােগ, মহামারীর । তেমনই একটি রােগের নাম সােয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সােয়াইন ফ্লু। সম্প্রতি বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে শূকরের একধরনের ভাইরাস মানুষের দেহে ঢুকে যে নতুন রােগটি সৃষ্টি করেছে তার নাম সােয়াইন ফ্লু । যাতে ইতােমধ্যে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। যেহেতু এটি মানুষের মাঝে বিস্তৃত হয়েছে তাই এ রােগের নামকরণ হয়েছে H1N1


সােয়াইন ফ্লু কী: সােয়াইন ফ্লু হচ্ছে মানবদেহের ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের মতােই এক ধরনের ভাইরাস, যা প্রধানত শূকরের দেহে দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। শূকরের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য মানবদেহের সাথে বেশ মিল থাকায় এ ভাইরাসটি পাখির চেয়ে দ্রুত মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।


সােয়াইন ফুর প্রকারভেদ: সােয়াইন ফ্লু বা সােয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা মূলত তিন প্রকার। যথা : ১. ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ ২. ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি ৩. ইনফ্লুয়েঞ্জা-সি। এই তিন প্রকার ভাইরাসই মানুষের দেহে রােগের সৃষ্টি করে। 'ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ' ভাইরাস শূকরের দেহে স্বাভাবিক ভাবে পাওয়া যায়, কিন্তু 'ইনফ্লুয়েঞ্জা-সি’ ভাইরাস কদাচিৎ পাওয়া যায় এবং 'ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি’ ভাইরাস এখনাে পর্যন্ত শূকরের দেহে পাওয়া যায় নি। 'ইনফ্লুয়েঞ্জা-সি’ ভাইরাস মানুষ এবং শূকরের দেহে প্রবেশ করে কিন্তু পাখির দেহে এর কোনাে সংক্রমণ ঘটে না। ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ' এর আবার প্রকারভেদ আছে। যেমন- H1N1, H1N2, H2N3, H3N1 এবং H3N2 । এগুলাের মধ্যে H1N1, H1N2 এবং H3N2, বিশ্বব্যাপী শূকরের দেহে স্বাভাবিক প্রসারণ ঘটে। ১৯৯৮ সালের আগে H1N1, ভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের শূকরের দেহে ব্যাপক প্রসার ঘটে।


সােয়াইন ফ্লু’র ইতিহাস: সর্বপ্রথম ১৯১৮ সালে সােয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জাকে মানুষের রােগের সাথে সম্পর্ক আছে বলে বিবেচনা করা হয় স্পেনে এর নামকরণ করা হয় 'স্প্যানিশ ফ্লু'। দশ বছর পর ১৯৩০ সালে শূকরের দেহে রােগ সৃষ্টিকারী হিসেবে একটি ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। এরপর ৬০ বছরে সােয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা H1N1, ভাইরাস ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। ১৯৫৭ সালে এশিয়ার কয়েকটি দেশে এ ফ্লু ছড়িয়ে পড়লে এর নামকরণ করা হয় এশিয়ান ফ্লু। ১৯৯৭ থেকে ২০০২ -এর মধ্যে নতুন তিন প্রকার ভাইরাস ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। ১৯৯৭- ১৯৯৮ সালের মধ্যে H3N2 দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ১৯৯৯ সালে কানাডায় H4N6 ভাইরাস পাখির দেহ থেকে শূকরের দেহে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু তা শুধু একটি খামারে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯১৮ সালে ভাইরাস শূকরের মতাে বিংশ শতাব্দীতে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে এবং এর প্রভাব স্বাভাবিক এবং সাময়িক। যা হােক এ ভাইরাস শূকরের দেহ থেকে মানুষের দেহে সরাসরি প্রবেশ করে না। 'জুনােসিস' হিসেবে মানুষের দেহে সােয়াইন ফ্লু অনেকবার লক্ষ করা গেছে। তবে এর প্রসারণ ঘটেছে ধীরে। শূকরের মধ্যে এ ভাইরাসের প্রসারের ফলে ব্যাপক ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি বিশেষ করে ব্রিটিশ মাংস কোম্পানি গুলাের প্রতি বছর প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।



সােয়াইন ফ্লুর প্রসারণ : সােয়াইন ফ্লু সরাসরি শূকর থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে না। তবে যারা পােল্টি খামার এবং শূকরের খামারে কাজ করে তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া একাধিক লােকের একই জায়গায়, বদ্ধ, স্যাতসেতে, নােংরা পরিবেশে বসবাসের মাধ্যমে একজনের দেহ থেকে আরেক জনের দেহে সংক্রমিত হয়। আবার যারা মাংস কোম্পানি গুলাের কাজ করে তাদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যারা এসব কোম্পানিতে কাজ করে তাদের উচিত সােয়াইন ফ্লু প্রতিরােধক টিকা গ্রহণ করা।


সােয়াইন ফ্লু’র লক্ষণ: বাংলাদেশে সােয়াইন ফ্লু’র যেসব লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে জ্বর বা সর্দি-কাশি । তবে জ্বরে আক্রান্ত হলেই সােয়াইন ফ্লু হয়েছে এমন ভাবার কোনাে কারণ নেই । সােয়াইন ফ্লু হলে রােগীর মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে-

জ্বর হবে এবং তাপমাত্রা ১০০.৪° ফারেনহাইটের বেশি হতে পারে।

মাংসপেশিতে ব্যথা হতে পারে।

তীব্র মাথাব্যথা ও গলাব্যথা হতে পারে।

হাঁচি ও কাশি থাকতে পারে।

বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।

ডায়রিয়া হবে।

শ্বাসকষ্ট হবে।


এছাড়াও নিউমােনিয়া, একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গা অবশ হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যু ঘটতে পারে। সাধারণ ফ্লু'র মতােই সােয়াইন ফ্লুও’ দুই থেকে পাঁচ দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।


ভাইরাস প্রতিরোধে প্রতিষেধক: এ ভাইরাস প্রতিরােধে মানবদেহে ব্যবহারের মতাে কোনাে প্রতিষেধক নেই, তবে শূকরের জন্য প্রতিষেধক রয়েছে। তবে এ ভাইরাসের সাথে মানবদেহের H|N, ভাইরাসের বেশ মিল থাকায় সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক ব্যবহার করলে তা কিছুটা সুরক্ষা দেবে।


সােয়াইন ফ্লু প্রতিরােধের উপায়: সােয়াইন ফ্লু প্রতিকার করতে হলে আতঙ্কিত বা ভিতু না হয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। সােয়াইন ফ্লু থেকে নিজের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। এগুলাের মধ্যে রয়েছে-

হাঁচি বা কাশির সময় আপনার নাক ও মুখ ভালােভাবে ঢেকে নিন এবং ব্যবহার শেষে টিস্যুটি ডাস্টবিন অথবা আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিন।

পানি ও সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত পরিষ্কার করুন, বিশেষ করে হাঁচি বা কাশির পর। এক্ষেত্রে অ্যালকোহল ভিত্তিক হ্যান্ডক্লিনার/হাত পরিষ্কারক কার্যকর।

আপনার চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এর ফলে জীবাণু ছড়ায়।

অসুস্থ ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।

এক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।

করমর্দনের সময় সাবধান থাকতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে ঐ ব্যক্তি ফুতে আক্রান্ত কিনা। হ্যান্ডশেক বহু রােগের জন্ম দেয়।

হাতের কজি পর্যন্ত নিয়মিত ধােয়ার অভ্যাস করতে হবে।

ফ্লু রােগে আক্রান্ত হলে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে যথা সম্ভব নিজেকে আলাদা রাখুন। জ্বর কমানাের কোনাে প্রকার ওষুধ ছাড়াই জ্বর সেরে গেলে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা বাড়িতে থাকুন।

ফ্লু জাতীয় রােগের লক্ষণ বা শ্বাসকষ্ট তীব্র হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তির জনবহুল স্থান যেমন বাজার, বাস, পাবলিক প্লেস, স্কুল-কলেজ ও অফিসে অবশ্যই প্রটেকশন ব্যবহার করতে হবে।


সােয়াইন ফ্লু’র চিকিৎসা: সােয়াইন ফ্লু'তে আক্রান্ত হলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এক্ষেত্রে রােগীকে বাড়িতে আলাদা ঘরে রাখতে হবে এবং রােগীসহ বাড়ির সবার ডিটারজেন্ট অথবা সাবানে পরিষ্কার করা কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। রােগীর যথাযথ বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যাজমা রােগী, ডায়াবেটিস রােগী, গর্ভবতী মহিলা, ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু, ৬৫ বা তদূর্ধ্ব বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি এবং ফুসফুস আক্রান্ত জনিত যে কোনাে রােগীর সােয়াইন ফ্লুতে ঝুঁকি থাকে। এজন্য এ ধরনের রােগীর যাবতীয় তথ্য নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জানাতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।


সােয়াইন ফ্লু ও বাংলাদেশ: ১৮ই জুন ২০০৯ দেশে সর্বপ্রথম সােয়াইন ফ্লু রােগী শনাক্ত করা হয়। তবে ৩১শে আগস্ট, ২০০৯ বাংলাদেশে প্রথম সােয়াইন ফ্লু আক্রান্ত রােগীর মৃত্যুর বিষয়টি নির্দিষ্ট করে রােগ তত্ত্ব, রােগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। ৩০ আগস্ট সাভারের মিতা চক্রবর্তী নামের এক রােগী ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে মারা যান। ১৮ই জুন ২০০৯ দেশে সর্বপ্রথম সােয়ান ফু রােগী শনাক্ত করা হয়।


সােয়াইন ফ্লু'র অন্যান্য তথ্য: সােয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয় সর্বপ্রথম মেক্সিকোর শিশু এদগার হার্নান্দেজ। এই ভাইরাসের উৎপত্তি স্থল মেক্সিকোর ‘ভেরক্রিজ’ রাজ্যের লা গ্লোরিয়াস’ নামক স্থান। ১১ই জুন ২০০৯ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO সােয়াইন ফু’কে মহামারী ঘােষণা করে। WHO ৩০শে এপ্রিল ২০০৯ সােয়াইন ফ্লু ভাইরাসের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করে Influenza (H1N1)। ২২ শে মে, ২০০৯ WHO-এর সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশ্বের ৪২টি দেশে সােয়াইন ফ্লু বিস্তার লাভ করে। যার মধ্যে রােগীর সংখ্যা ১১, ১৬৮ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৮৬ জন । সােয়াইন ফ্লু শনাক্ত করার যন্ত্রের নাম 'রিয়েল টাইম পিসিআর’ । যার দাম প্রায় ৪০ লাখ টাকা। সােয়াইন ফ্লু শনাক্ত করার জন্য মানুষের নাকের ভেতরের সর্দি বা রস নিয়ে যন্ত্রে পরীক্ষা করা হয়। কোনাে ব্যক্তির সােয়াইন ফ্লু হয়েছে বলে সন্দেহ হলে, তিনি নিজেই মহাখালীতে অবস্থিত ‘আইইডিসিআরবি’-এ গিয়ে বিনামূল্যে পরীক্ষা করাতে পারবেন।


উপসংহার: সুখ-দুঃখ, রােগ-শােক মানুষের জীবনের নিত্য সঙ্গী। সােয়াইন ফ্লু বা ফু জাতীয় যে কোনাে রােগ হলেই ভিতু বা আতংকিত না হয়ে ধৈর্য সহকারে এর সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজে সচেতন হয়ে সচেতন করতে হবে পাশের মানুষটিকে, সমাজকে। তাহলেই আমরা একটি সুস্থ, সুন্দর, সােয়াইন ফ্লু-মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারব।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url