১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতা,হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নতি হয়, নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য দ্রুত কমাতে থাকে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়।
ঠিকই এমনি সময় সংঘটিত হয় ১৫ আগস্টের নির্মম, নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভাের রাতে নিজ বাসভবন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে কতিপয় আদর্শচ্যুত সেনা কর্মকর্তার যোগসাজশে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় । সে রাতে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন নেছা, জ্যোষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রােজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত, তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ, ভ্রাতুস্পুত্র শেখ সেরনিয়াবত, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশাের রিন্টুসহ ১৬ জনকে ঘাতকরা হত্যা করে।
বিদেশে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ঘাতকরা নির্মম হত্যাকাণ্ড শেষে কঠোর সামরিক নিরাপত্তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে গােপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া এবং অন্যদেরকে বনানী কবরস্থানে দাফন করে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে ঘাতকদের আশীর্বাদপুষ্ট সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়। এর পরপরই দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। যদিও সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ও বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুত কিছু সেনা সদস্য কর্তৃক এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তবু এর সাথে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তি ও এদের প্রতিক্রিয়াশীল সহযােগী গােষ্টীর যে সংশ্লিষ্ঠতা ছিল, তা এখন বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়। মূলত এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একটিমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল গঠনকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত সাময়িক বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিহিতির সুযােগ নেয়। এই হত্যাকাণ্ড কেবল একজন বা কয়েকজন ব্যক্তিকেই হত্যা করা ছিল না, এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল একটি আদর্শকে হত্যা করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু সংবিধান থেকে নয়, বাঙালি মন থেকে মুছে ফেলা। স্বভাবতই হত্যাকাণ্ডটি ছিল সুপরিকল্পিত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুদূরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাব আজো বিদ্যমান।
রাজনীতিতে স্বাধীনতা বিরােধী শক্তির উত্থান ঘটে এই হত্যাকাণ্ডের পর। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও অপব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ধর্মানিরপেক্ষতার স্থলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এই সময়ে রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুকৌশলে ভুলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। এই সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর নানাভাবে আঘাত হানার চেষ্টা করা হয়। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতন গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধবংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় । এইভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে একটি আদর্শকে চিরতরে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরাজিত ও ঘাতক শক্তি কখনাে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে মুছে দিতে পারেনি। কারণ বাঙালির রক্তের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মিশে আছে।