রহস্য রোমাঞ্চে ঘেরা আমাজন জঙ্গল এবং এলডোরাডো রহস্য
সময়ের বিবর্তনে আমরা যতই চাঁদ, মহাকাশ,সমুদ্র জয় করি না কেন, পৃথিবীর অনেক রহস্যই আজও আমাদের কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। বিচিত্র এই পৃথিবীতে এখনও এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে এখনো মানব সভ্যতার আলো পৌঁছাতে পারে নি। মানব জাতির কাছে এখনো সেই জায়গা গুলো রহস্যাবৃত।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত গুলো রহস্যময় স্থান রয়েছে, সেইগুলোর মধ্যে আমাজন জঙ্গল অন্যতম রহস্যময় একটি জায়গা । এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জঙ্গল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ অক্সিজেন আমরা এই অ্যামাজন(Amazon) জঙ্গল থেকেই পেয়ে থাকি।
অ্যামাজন জঙ্গলের অবস্থান আমাজন নদীর অববাহিকায় ।একে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় বন বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে অবস্থিত এবং ৯টি দেশের সাথে এই বিরাটাকার জঙ্গলটি অন্তর্ভুক্ত। অ্যামাজন জঙ্গলের। আয়তন প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। অত্যন্ত ঘন এবং বিশাল এই জঙ্গলটি অত্যন্ত দুর্গম। এই জঙ্গলটিতে এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে এখনো সূর্যের আলো পৌঁছায় নি।
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন অভিযাত্রীরা অ্যামাজন অভিযান করেছেন। যদিও তাদের এই যাত্রার আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বর্ণ, রৌপ্যর খোঁজ করা। এ অভিযান এখনো অব্যাহত। বিভিন্ন অভিযাত্রীরা , বিশেষ করে পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত যে বিশাল এ অ্যামাজনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে ‘এলডোরাডো’(Eldorado) নামক এক গুপ্ত শহর। বলা হয়ে থাকে এই শহর পুরোপুরি সোনার তৈরি। প্রাচীন এই ভ্রান্ত ধারণাটি এসেছে মূলত গ্রিক সাহিত্যের পৌরাণিক গল্প থেকে। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যেও 'এলডোরাডো' নামক এক শহরের উল্লেখ রয়েছে। আমরা এলডোরাডো রহস্য সম্পর্কে আগেও জেনেছি! বলা হয়ে থাকে, এই রহস্যময় শহরটিকে হয়েছে এক শ্রেণীর বিশেষ নারী যোদ্ধা যাদেরকে ‘আমাজন’ বলে অভিহিত করা হয় তারা যুগের পর যুগ ধরে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে।
পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রী সহ আরো অনেক অভিযাত্রীরা এই সোনার শহর খুঁজে পাওয়ার আশায় অভিযান পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে কেউ এখনো এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পায়নি। এমনকি অনেক অভিযাত্রী এই অ্যামাজনের বিশালতা মধ্যেই হারিয়ে গেছে।
অ্যামাজন কে পৃথিবীর বৃহত্তম রেইনফরেস্ট বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়। অ্যামাজন জঙ্গলকে রেইনফরেস্ট বলার প্রধান কারন হল এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা এই জঙ্গলে বর্ষা মৌসুমে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত এবং গরম কালে আবহাওয়া প্রচন্ড গরম হয়ে থাকে। মূলত প্রচণ্ড গরমের কারনে এখানে আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে। অ্যামাজনের এই বিশাল প্রানী ও উদ্ভিদকুলের বৈচিত্রের প্রধান কারন এখানকার এই গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতা।
এখানে রয়েছে (সরকারী হিসাব অনুযায়ী) ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গ ১,২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী। এছাড়াও এখানে এমন অনেক প্রানী রয়েছে যাদের পরিচয় বিজ্ঞানীরা এখনো পান নি। এছাড়াও রয়েছে হাজার প্রজাতির অণুজীব।
এখানকার ইকোসিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী যা কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে। এই বনের প্রানিদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো জাগুয়ার, গোলাপি ডলফিন, তামানডুয়া, তাপির, মানাতি, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি,বাদুড় , ঈগল, টুকান, হোয়াটজিন, দ্রুতগামী হামিং বার্ড ইত্যাদি। পৃথিবীর মোট পাখির এক পঞ্চমাংশ পাখি এই বনের অধিবাসী।
মাছের মধ্যে আছে মাংসাশী লাল পিরানহা, বিপদজনক বৈদ্যুতিক মাছ এবং স্বাদু পানির অন্যতম বড় মাছ-পিরারুকু, যার ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। উভচর প্রাণীর মধ্যে লাল চোখ বিশিষ্ট গেছো ব্যাঙের নাম না বললেই নয়। সরিসৃপের মধ্যে আছে বিখ্যাত সাপ বোয়া যা তার শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। তাছাড়া রয়েছে কুমির, অ্যালিগেটর, কচ্ছপ প্রভৃতি। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়া, রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা আর জানা অজানা হরেক রকমের পোকা-মাকড়ের বসতি এই জঙ্গলে। এই অ্যামাজনে এমন অনেক প্রজাতির প্রানী রয়েছে যাদের পরিচয় বিজ্ঞানীরা এখনো পান নি। পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর প্রানিদের আবাসস্থল এই অ্যামাজন।
দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল নদী আমাজানের পাশ ঘেষে গড়ে ওঠা ব্রাজিলের অ্যাকরি রাজ্যের পেরুর সীমান্ত ঘেঁষা গভীর জঙ্গল অ্যামাজনে যে শুধু হরেক রকমের প্রানী বসবাস করে তা নয়, এখানে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন উপজাতি। বর্তমান পৃথিবীর সভ্যতার আলো এখনো এদের স্পর্শ করে নি। সভ্য দুনিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগই নেই এদের। যাদের অনেকের সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ নেই সভ্য দুনিয়ার। গভীর অরণ্যে গাছের বাগান ঘেরা কুঁড়েঘরের এরা বসবাস করে। জঙ্গলের গাছগাছালির বাকল দ্বারা এরা এদের লজ্জা নিবারণ করে থাকে। জঙ্লী জন্তুর হাত থেকে রক্ষার জন্য এদের একমাত্র উপায় বর্শা। বনের পশু, ফলমূলই এদের জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন। ধারনা করা হয়, অরণ্যচারী এই মানবগোষ্ঠীটি ছোট এবং তাদের সঙ্গে সভ্য জগতের কোনো সম্পর্কই নেই।
ব্রাজিল সরকারের ধারণা মতে গভীর অরণ্যে বাস করা এই মানবগোষ্ঠীটির লোকসংখ্যা প্রায় দুশো। নানা কারনে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে সরকার ইচ্ছে করেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করার পলিসি গ্রহণ করেছে। এই ছোট্ট গোষ্ঠীটি যাতে সভ্য মানুষদের অরণ্যধ্বংস, মাইনিং, গবাদি পশু পালন, মাছধরা, অবৈধ শিকারসহ স্বেচ্ছাচারিতার শিকার না হয়, সেই জন্য ব্রাজিল সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন।
বলা হয়ে থাকে প্রাচীন এই আসহানিনকা উপজাতী গোষ্ঠীর লোকেরা অন্য আরো একটি ছোট গোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে এই অঞ্চলে ভাগাভাগি করে থাকে। এছাড়াও আমাজানে সভ্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন আরো কয়েকটি ছোট্ট গোষ্ঠী আছে। এইসব গোষ্ঠীগুলো যেনো বিলুপ্ত না হয়ে যায় সেজন্যে ব্রাজিল সরকার ও এনজিওগুলো কাজ করছে। সভ্য দুনিয়ার কাছে অ্যামাজন এখনো একটি রহস্যের নাম। আশা করা যায় কোনো একদিন এই রহস্যের সমাধান আমরা করতে পারব।