পরিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনা
শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনা
অথবা, নকল মুক্ত পরীক্ষা অনুচ্ছেদ রচনা
অথবা, পরীক্ষায় দুর্নীতি ও তার প্রতিকার
অথবা, পরীক্ষায় দুর্নীতি প্রতিরােধের উপায়
অথবা, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন
অথবা, দুর্নীতি ও তার প্রতিকার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা
(সংকেত: ভূমিকা– পরীক্ষায় দুনীতি— দুনীতির ধরন— দুনীতির কারণ—দুনীতির ফলাফল— দুনীতি প্রতিরােধ- উপসংহার)
ভূমিকা : ১৭ মার্চ ২০০২। দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় এসএসসি পরীক্ষা সংক্রান্ত হেড লাইন, “এস. এস. সি. পরীক্ষা। ৪৬১৮ পরীক্ষার্থী বহিষ্কার।” এই হচ্ছে বর্তমানে আমাদের পরীক্ষার চিত্র। দুঃখজনক হলেও এটিই এখন বাংলাদেশের বাস্তবতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের ত্রিশ বছর পর যেখানে প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর একটি দেশ। সেখানে আমাদের অর্জন হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি এদেশে প্রভাব বিস্তার এতটাই ঘটিয়েছে যে, পরীক্ষাক্ষেত্র অর্থাৎ শিক্ষাঙ্গনও আজ এর নির্মম টার্গেটে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নের একটি পদ্ধতি। এর বর্তমান রূপ দেখে তাই আলেকজান্ডার-এর ভাষায় বলতে হয়— “সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ।”
পরীক্ষায় দুর্নীতি : দুর্নীতি বিভিন্নরূপে আমাদের সমাজে বিদ্যমান। পরীক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিও তেমনই ভয়াবহ, যার পরিণাম জাতির সর্বনাশ। কেননা একজন আমলার দুর্নীতিতে ঐ আমলা শ্রেণির আওতাধীন বিষয়ের ক্ষতি হয়। একজন মন্ত্রী দুর্নীতি করলে তার মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক জন ব্যবসায়ী দুর্নীতি করলে অন্য ব্যবসায়ীরা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি গােটা জাতিকে নিশ্চিতভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বর্তমান অবস্থা এতই করুণ যে, তারা যেন-তেন প্রকারেই পরীক্ষা নামক বৈতরণী পার হতে পারলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তাই পাঠ্য বই না পড়ে কেবল নকল করে বাের্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেডমার্ক লাগানােতে তারা ব্যস্ত। ফলে এদেশের পরীক্ষা এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
দুনীতির ধরন : বর্তমানে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই পরীক্ষায় দুর্নীতিতে ব্যস্ত। এগুলাে হলাে :
১। পরীক্ষায় নকল করা।
২। অসৎ পরীক্ষক, নিরীক্ষক কিংবা অসাধু বাের্ড কর্মচারীদের দ্বারা নম্বর বাড়িয়ে নেওয়া।
৩। একজনের পরীক্ষা অন্যজনকে দিয়ে দেওয়ানাে।
এসব কাজে তারা ব্যয় করছে প্রচুর টাকা-পয়সা। অথচ ছাত্রদের কাজ লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জন। তারা যদি এভাবেই পার পেয়ে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে।
দুর্নীতির কারণ : আমাদের দেশের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা পদ্ধতি এর প্রধান কারণ। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা শৈশব থেকে রােগীর তিক্ত ওষুধ খাওয়ার মতাে চোখ-কান বুজে কোনাে রকমে শিক্ষাকে গলধঃকরণ করে থাকে। অর্থাৎ রােগীর সাথে ঔষধের যে সম্পর্ক, আমাদের দেশের শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদের সেই সম্পর্ক। তাছাড়া প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশ হলেও নৈতিক উন্নতি আদৌ হচ্ছে না। পরীক্ষায় দুর্নীতি অর্থাৎ নকলপ্রবণতার জন্য অনেক ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষার্থীকে দায়ী করা হয়। এটি মােটেও গ্রহণ যােগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে এর জন্য গােটা সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। ২০০২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় নকলে সহযােগিতার জন্য প্রায় দু'শ শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছে (দৈনিক জনকণ্ঠ ৩১ মার্চ ২০০২)। পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের চাহিদা যেভাবে হােক ছেলে-মেয়েকে পূরণ করতেই হবে। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করে লােভী স্বভাবের কিছু শিক্ষককে। এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কিছু সংখ্যক শিক্ষক তাদের ছাত্র-ছাত্রীকে হাতে-কলমে দুর্নীতি শিক্ষা দেন এবং প্রয়ােজনে পরীক্ষা কেন্দ্রে স্বহস্তে নকল সরবরাহ করেন। পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় নিম্নোক্ত বিষয় সমূহকে-
১। আর্থ-সামাজিক অবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত।
২। অভিভাবকদের উদাসীনতা।
৩। শিক্ষকদের কর্তব্যে অবহেলা।
৪। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি চর্চা ও প্রতিকূল পরিবেশ।
৫। ত্রুটিপূর্ণ ও নীরস সিলেবাস এবং পরীক্ষা পদ্ধতি।
দুর্নীতির ফলাফল : পরীক্ষায় নকলপ্রবণতা এভাবে চলতে থাকলে দেশ একসময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে—একথা নিশ্চিত। এর বড় প্রমাণ হলাে, দেশের মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা শিক্ষায় উন্নত হলেও দেশের মান বাড়ছে না। আর এটি হওয়া স্বাভাবিক। যে নিজে দুর্নীতি করে সফল হয়েছে। সে কখনাে দুনীতি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। মনে রাখতে হবে মিথ্যা কখনও সত্যের সংস্থাপক হতে পারে না। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও পরবর্তীতে তাদের অর্জিত সার্টিফিকেট কোনাে কাজেই আসছে না।
দুর্নীতি প্রতিরােধ : পরীক্ষায় দুর্নীতি রােধ করতে চাইলে জরুরিভিত্তিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে :
ক) শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ : শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা যেন নিয়মিত ক্লাসে আসে তার জন্য উপস্থিতি খাতার যথার্থ ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে দরকার শিক্ষকদের ঐকান্তিক আগ্রহ । এখানে শিক্ষকগণ যুক্তি দেখান যে, তারা নিরাপত্তার অভাবে ছাত্রদেরকে বিভিন্ন সুবিধা দিতে বাধ্য হন। তাই সরকারকে শিক্ষকদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
খ) অভিভাবকদের ভূমিকা : পরীক্ষায় দুর্নীতি রােধে অভিভাবকদের ভূমিকাও বিশাল। তাদের মনে রাখতে হবে প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া। জীবনের উন্নতি সম্ভব নয়। দুর্নীতিল শিক্ষা দিয়ে হয়তাে কিছুক্ষণ টেকা যায়, তবে একসময় প্রকৃত অবস্থা বের হয়ে আসবেই।
গ) শিক্ষকদের দায়িত্ব : শিক্ষকদেরকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এমন অবস্থা চলতে থাকলে একসময় শিক্ষকদের মূল্যায়ন থাকবে না। আর তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবােধও ধ্বংস হয়ে যাবে।
ঘ) ছাত্র-রাজনীতি : ছাত্র-রাজনীতি সরাসরি বন্ধ করতে হবে। ছাত্র-রাজনীতিই এ দেশের শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতির শিকড় গেড়েছে। ছাত্র- রাজনীতির অপচর্চা একজন শিক্ষার্থীকে দুঃসাহসী করে তােলে।
ঙ) পাঠ্যসূচির আধুনিকায়ন : আমাদের পাঠ্যসূচি সেই পুরনাে ধাঁচের। একে যুগােপযােগী করতে হবে। পাশাপাশি কোর্স পদ্ধতির লেখাপড়া মাধ্যমিক স্তরেও প্রবর্তন করতে হবে।
চ) পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন : পরীক্ষাপদ্ধতিতেও আনতে হবে পরিবর্তন। বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার প্রয়ােগ সম্পর্কিত প্রশ্ন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে নকলের সুযােগ থাকবে না। এতে মেধা-মননেরপ বিকাশও ঘটবে
উপসংহার : পরীক্ষায় নকলের দাবিতে মিছিল’-এ খবর যখন জাতীয় দৈনিকের শিরােনাম তখন কষ্ট হয় এই ভেবে যে, কোনদিকে যাচ্ছি আমরা? এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। মাছের মাথায় পচন ধরলে মাছ যেমন বাঁচে না, তেমনই একটি দেশের মাথা হচ্ছে তার শিক্ষা ব্যবস্থা। এতে যেভাবে পচন ধরেছে, তাতে এ দেশ বাঁচবে কিনা সন্দেহ। ইদানীং সরকার এ অবস্থা দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা প্রয়ােজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সরকার এখনও ছাত্র-রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে গৃহীত পদক্ষেপ কোনাে কাজেই আসছে না।