প্রোগ্রাম ও প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ কি এবং প্রোগ্রামিং ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

প্রোগ্রামিং ভাষা বা প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম জানতে হবে প্রোগ্রামিং কি বা প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ কাকে বলে। প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ হচ্ছে একপ্রকার কৃত্রিম ভাষা। প্রোগ্রাম হচ্ছে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য কম্পিউটারের ভাষায় ধারাবাহিক ভাবে কতগুলো নির্দেশনা বা কমান্ডের সমষ্টি। এবং যার মাধ্যমে এই প্রোগ্রাম (Program) রচিত হয় অর্থাৎ, কম্পিউটার সিস্টেমে প্রোগ্রাম রচনার জন্য ব্যবহৃত শব্দ, বর্ণ, অঙ্ক, সংকেত এবং এগুলো বিন্যাসের নিয়ম গুলোকে একত্রে বলা হয় প্রোগ্রামের ভাষা বা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ (Programing Language). এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশ-কে নিয়ন্ত্রন এবং পরিচালনা করা সম্ভব। বিশেষ করে কম্পিউটার-কে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রামের প্রয়োজন হয়। এবং বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরি করা হয় বিভিন্ন কাজের জন্য এই কৃত্রিম ভাষার মাধ্যমে।ব্যবহারের সুবিধার্থে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং ভাষার সৃষ্টি হয়েছে এগুলো হলে, সি (C), সি++ (C++), ভিজুয়াল বেসিক (Visual Basic), জাভা (JAVA), ওরাকল (ORACLE), অ্যালগল (ALGOL), ফোরট্রান (FORTRAN), পাইথন (Python) ইত্যাদি। প্রতি বছর-ই নতুন নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা(Programing Language) তৈরি হচ্ছে। আসুন উল্লেখিত প্রোগ্রামিং ভাষা গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি:-

সি (C)- ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরিতে ডেনিস রিচি সি (C) ভাষার উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে অত্যন্ত শক্তিশালী ও জনপ্রিয় উচ্চতর ভাষা হিসেবে সি পরিচিত। সি ভাষা দিয়ে অপারেটিং সিস্টেম থেকে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন প্রােগ্রাম, জটিল ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট প্রােগ্রাম, ইন্টারনেট ব্রাউজার কিংবা ইন্টারপ্রেটার পর্যন্ত সবকিছু তৈরি করা যায়। এটি একটি ভাষা যা দিয়ে ছােট ছােট অসংখ্য অংশকে সমন্বয় করে একটি জটিল প্রোগ্রাম তৈরি করা যায়। এ ভাষাটি জানা থাকলে অন্য যে কোন ভাষা শেখা সহজ। সি ভাষায় অ্যাসেম্বলি ও উচ্চতর ভাষার প্রােগ্রামিং কৌশলের সমন্বয় সাধন করা যায়। অর্থাৎ ভাষায় বিট, বাইট, মেমােরি অ্যাড্রেস নিয়ে কাজ করা যায়, আবার উচ্চতর ভাষার মতাে ডেটা টাইপ নিয়েও কাজ করা যায় বলে এটি মধ্যস্তরের ভাষা হিসেবে পরিচিত। কম জায়গা ও রিসাের্স নিয়ে কাজ করা সফটওয়্যার তৈরিতে সি বেশি উপযােগী।

সি++ (C++)- সি++ একটি বহুলব্যবহৃত অবজেক্ট অরিয়েন্টেড প্রােগ্রাম ভাষা। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এটিএন্ডটি বেল ল্যাবরেটরিতে বিজারনি স্ট্রাউস্ট্রাপ এ ভাষা উদ্ভাবন করেন। প্রথমে এর নাম ছিল ‘সি উইথ ক্লাস। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু নতুন। বৈশিষ্ট্য যােগ করে ১৯৮৩ সালে সি++ নামকরণ করা হয়। সি++ এ সি-এর প্রায় সব বৈশিষ্ট্যসহ অতিরিক্ত আরও কিছু বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা আছে। এজন্য সি++ কে সি-এর বর্ধিত সংস্করণ বা সুপারসেট বলা যায়। টেক্সট এডিটর তৈরি, কম্পাইলার ও ইন্টারপ্রেটার তৈরি, ডেটাবেজ হ্যান্ডলিং, কমিউনিকেশন সিস্টেম ডিজাইন, ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম ডিজাইন, রিয়েল-টাইম সিস্টেম ডিজাইন ও উইন্ডােভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনসমূহ সি++ এর অনন্য অবদান। সি++ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এক্স উইন্ডাে সিস্টেম, কিউট ইত্যাদির মতাে গ্রাফিক্যাল ডিসপ্লে ম্যানেজমেন্ট প্রােগ্রামিং । অবজেক্ট অরিয়েন্টেড প্রােগ্রামিং এর দুনিয়ায় একটি কিংবদন্তি এবং জাভার সৃষ্টির প্রেরণা হলাে সি++। মজিলা ফায়ারফক্স আর ক্রোমিয়াম ব্রাউজারও কিন্তু বেশিরভাগই সি++ এ লেখা।

ভিজুয়াল বেসিক (Visual Basic)- দ্রুত এবং সহজে প্রােগ্রাম উন্নয়নের জন্য ভিজুয়াল বেসিক অতুলনীয়। বিশেষত নতুন বা অদক্ষ প্রােগ্রামারদের কাছে এ ভাষা জনপ্রিয়। মাইক্রোসফট বেসিক ল্যাঙ্গুয়েজকে কিনে সেটাকে ডেভেলপ করে এবং ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট এনভায়রনমেন্ট (IDE) সহ ১৯৯১ সালে ভিজুয়াল বেসিক নামে বাজারে ছাড়ে। ড্রাগ অ্যান্ড ড্রপ, অ্যাকটিভ এক্স কন্ট্রোল, সরাসরি এক্সিকিউটেবল ও ডায়নামিক লাইব্রেরি লিংক (DLL) তৈরির সুবিধার কারণে ভিবির কদর অনেকের কাছেই বেশি ছিল। ভিজুয়াল বেসিকে খুব সহজে বিভিন্ন ডেটাবেজ বিষয়ক সফটওয়্যারের সাথে সংযােগ করা যায়। তাছাড়া ভিজুয়াল বেসিক স্ক্রিপ্ট সহজে ওয়েবপেজ উন্নয়নে সুবিধা প্রদান করে। ভিৰিকে ডটনেটে যুক্ত করে ভিজুয়াল বেসিক ডটনেট হিসেবে ছাড়া হয়। মাইক্রোসফটের ডটনেট তৈরিতে ভিবির অনেক আইডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। ডটনেট হলাে মাইক্রোসফটের ফ্রেমওয়ার্ক, যাতে আছে ওয়েব ও ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশন তৈরির নানারকম এপিআই। উইন্ডােজের অনেক অ্যাপ ভিবি  ডটনেটে তৈরি হচ্ছে।

জাভা (Java)- Java একটি শক্তিশালী আধুনিক প্রােগ্রাম ভাষা। ১৯৯১ সালে সান মাইক্রো সিস্টেম জাভা প্রােগ্রামিং ভাষার সূচনা করে। ইন্টারনেটের জন্য ব্যবহারিক সফটওয়্যার উন্নয়নে এ ভাষার ব্যবহার অতুলনীয়। এজন্য জাভাকে সি++ এর ইন্টারনেট সংস্করণও বলা যায়। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক প্রােগ্রামিং-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাভা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জাভা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে এটি একটি প্লাটফর্মে কম্পাইল করে নিলে সেরকম অন্য যে কোনাে প্লাটফর্মে সরাসরি ব্যবহার করা যায়। (WORA : Write Once, Run Anywhere) । জাভা স্ক্রিপ্ট ভিজুয়াল বেসিক স্ক্রিপ্টের ন্যায় ওয়েবপেজ উন্নয়নের সুবিধা প্রদান করে। জনপ্রিয় ওয়েব ব্রাউজার গুলাে ওয়েব পেজের ভেতরে জাভা অ্যাপলেট চালু করার সক্ষমতা দেয়ার কারণে এটি খুবই দ্রুত সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

ওরাকল (ORACLE)- ড.ই.এফ.কড (Dr. E.F.Codd) এর সুদীর্ঘ গবেষণার ফল ওরাকল। সি এবং জাভা ল্যাঙ্গুয়েজ এর সমন্বয়ে ওরাকল। ডেভেলপ করা হয়েছে। ওরাকল কর্পোরেশন প্রথম কোম্পানি, যারা বাণিজ্যিকভাবে একটি রিয়েল রিলেশনাল ডেটাবেজ প্রােগ্রাম বাজারে ছেড়েছে। ওরাকল বর্তমান বিশ্বে নেটওয়ার্ক বেসড ডেটাবেজ প্রােগ্রাম হিসেবে গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ডেটাবেজ প্রােগ্রাম হিসেবে ওরাকল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ওরাকলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অত্যন্ত মজবুত। তাছাড়া এর সিকিউরিটি সিস্টেম বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। বর্তমানে ওরাকল, ডেটাবেজ ডেভেলপারগণের নিকট একটি আদর্শ ডেটাবেজ প্রােগ্রাম হিসেবে বিবেচিত। ওরাকল ডেটাবেজ প্রােগ্রামে RDBMS এর সর্বাধিক রুলস্ প্রয়ােগ করা যায়।

অ্যালগল (ALGoL)- অ্যালগল অ্যালগরিদমিক ল্যাঙ্গুয়েজ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ১৯৫৮ সালে সব কম্পিউটারে ব্যবহারযােগ্য সর্বজনীন ভাষা উদ্ভাবনের চেষ্টার ফলে ইউরােপে এ ভাষার উদ্ভব হয়। এটি মূলত ফোরট্রন লাঙ্গুয়েজের বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণের জন্য তৈরি হয়। ইউরােপিয়ান এবং আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের একটি কমিটি সমম্বিতভাবে এটি তৈরি করে। এতে তিনটি সুনির্দিষ্ট সিনট্যাক্স ছিল। সিনট্যাক্স তিনটি হলাে- রেফারেন্স সিনট্যাক্স, পাবলিকেশন্স সিনট্যাক্স এবং ইমপ্লিমেন্টেশন সিনট্যাক্স। প্রধানত বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত সমস্যা সমাধানের জন্য এটি আমেরিকা এবং ইউরােপের গবেষক কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করতাে।

ফোরট্রান (FORTRAN)- ইংরেজি FORTRAN শব্দটির পূর্ণরূপ Formula Translation । গাণিতিক উপায়ে বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত সমস্যা সমাধানের জন্য এ ভাষা অত্যন্ত উপযােগী। ১৯৫৭ সালে আইবিএম কোম্পানি এ ভাষা চালু করে। বর্তমানে এ ভাষার প্রচলন কমে এসেছে। অনেক পুরনাে হলেও ফোরট্রানের প্রয়ােজনীয়তা শেষ হয়নি। অত্যান্ত দ্রুত হিসাব করতে পারে বলে বড় বড় সিমুলেশনে এখনাে এ ভাষাটি ব্যবহৃত হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীর চেয়ে সুপার কম্পিউটার ও হাই পারফরমেন্স কম্পিউটিং-এ ফোরট্রান ব্যবহার করা হয়। ফোরট্রান ব্যবহার করে পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়নের অনেক বড় বড় গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে রাখায় এখনাে তার কোন কোনােটি বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় ব্যবহার করেন।

পাইথন (Python)- পাইথন হচ্ছে প্রােগ্রামিং ভাষাসমূহের মধ্যে অন্যতম হাই লেভেল অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড ভাষা। ডায়নামিক ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন সহ অনেক কিছু বানাতে এটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৯ সালে নেদারল্যান্ডের এক বিজ্ঞানী ভ্যান রােসাম (Van Rosum) এ ভাষাটি রচনা করেন। পাইথনের কোর সিনট্যাক্স খুবই সংক্ষিপ্ত, তবে ভাষাটির স্ট্যান্ডার্ড লাইব্রেরি অনেক সমৃদ্ধ। অন্যান্য ল্যাংগুয়েজের যতরকম ফিচার বা নতুন নতুন সাপাের্ট আসে, সবই পাইথনে খুব সহজে ব্যবহার করা যায়। লিনাক্স বেজড অপারেটিং সিস্টেমে বহু প্রােগ্রাম লেখা হয় পাইথনে। ইউটিউব, গুগল অ্যাপইঞ্জিন ইত্যাদি সাইটগুলাে চলতে পাইথনের ওয়েবকিটের শক্তিতে। তথ্য নিরাপত্তা শিল্পে পাইথনের বহুবিধ ব্যবহার লক্ষণীয়। সাধারণত দ্রুত সফটওয়ার নির্মাণের জন্য পাইথন ব্যবহৃত হয়। যে সমস্ত বড় প্রতিষ্ঠান পাইথন ব্যবহার করে তাদের মধ্যে গুগল ও নাসা উল্লেখযােগ্য এটি বর্তমানে জনপ্রিয় ভাষাগুলাের একটি এবং ২০১৮  সালে এটি IEEE কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ প্রােগ্রামিং ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি বিভিন্ন প্লাটফর্মে চলে এবং ক্লাউড ভিত্তিক ওয়েব এ্যাপ্লিকেশন, ডেটা অ্যানালাইসিস ও মেশিন লার্নিং অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url