রচনা: এইডস এ যুগের ঘাতক ব্যাধি
রচনা: এইডস এ যুগের ঘাতক ব্যাধি
ভূমিকা: বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মানবসভ্যতার জন্যে মারাত্মক হুমকি হিসেবে আবিষ্কৃত হয় ‘ 'ঘাতক ব্যাধি এইডস'। একুশ শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের মাঝেও বিশ্বব্যাপী এইডস জনস্বাস্থ্যের জন্যে একটি মারাত্মক দুমকি। পৃথিবীর কোনাে কোনাে অঞ্চলে এটি বর্তমানে একনম্বর ঘাতক ব্যাধি। বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, পূর্ব ইউরােপ ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এ রােগের প্রকোপ দেখে বিণ সম্প্রদায় আজ আতঙ্কগ্রস্ত। এ রােগে আক্রান্ত হলে শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। ফলে কোনাে রােগের জীবাণু, যেমন: যক্ষ্মা, ডায়রিয়া ইত্যাদি সহজে আক্রমণ করতে পারে এবং শরীরে রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা না থাকায় রােগী ক্ৰমে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।
এইডস-এর উৎপত্তিকাল: ঘাতক ব্যাধি এইডস কখন, কোনকালে মানুষকে ছােবল মেরেছে তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায় নি। ১৯৮১ সালে আমেরিকায় প্রথম 'এইডস রােগ ধরা পড়ে। তারও আগে আফ্রিকাতে এ রােগের বিস্তৃতি ঘটেছে বলে গবেষকদের ধারণা। অনেকের মতে, এক জাতের বানরের মাধ্যমে এইডস রােগের উৎপত্তি। এ রােগের উৎপত্তির প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে- মূলত নারী- -পুরুষের দৈহিক মিলনের মাধ্যমেই এইডস রােগের বিস্তার ঘটে। অর্থাৎ এ পর্যন্ত আবিস্কৃত পানি বাহিত, বায়ুবাহিত ইত্যাদি রােগের সাথে নতুন ভাবে যােগ হয়েছে যৌনবাহিত ভয়ংকর ব্যাধি এইডস।
এইডস: 'এইডস' এক প্রকার ভাইরাস দ্বারা গঠিত ব্যাধি। এ রােগ HIV নামক ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। ভাইরাসটির রূপরেখা চিহ্নিত করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় 'হিউম্যান টি সেল লিম্ফোট্টপিক ভাইরাস থ্রি’ যার সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে HTLV- এ। অপরদিকে 'অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনাে ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রমড' (Acquired Immune Deficiency Syndrome) -এর সংক্ষিপ্ত নাম হচ্ছে AIDS (এইডস)। এইডস-এর ভাইরাস দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে রক্তে রােগ প্রতিরােধক T4. কোষকে ধবংস করে এইডস- আক্রান্তকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়। ভাইরাস HIV খুব দ্রুত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনশীল বলে এর প্রতিষেধক তৈরি করা চিকিৎসা বিজ্ঞানের পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি।
এইডস-এর উপসর্গ: মরণ-ব্যাধি এইডস-এর লক্ষণ সমূহ নিম্নরূপ:
- এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের ওজন হ্রাস পেতে থাকে।
- মাঝে মাঝে ছােটখাটো জ্বর, মাথাব্যথা ও দৃষ্টি শক্তি হ্রাস।
- গলা, বগল ও কুচকীর ব্যথাহীন গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
- শুকনাে কাশি, নিঃশ্বাসে কষ্ট, গলাব্যথা বিশেষ করে খাবার সময়ে।
- মুখের ভেতর জিভে ও ঠোটে সাদা পর্দা পড়া।
- সীমাহীন দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তিহীনতা।
- হজম শক্তি কমে যাওয়া।
- পিঠে মুখে গলায় ফুসফুরি, চামড়ায় বিভিন্ন স্থানে লালচে দাগ। কোনাে ব্যথা নেই কিন্তু ভেতরটা শক্ত এবং দেখতে বিশ্রী।
- মুখের অভ্যন্তরে ঘা সৃষ্টি হওয়া।
- স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতি।
উল্লিখিত উপসর্গসমূহ দেখা দিলে HIV পরীক্ষার মাধ্যমে এইডস-আক্রান্ত বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
এইডস-রােগের কারণ: বিভিন্নভাবে এইডস রােগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বীর্য বা জরায়ু রসের সঙ্গে যদি সুস্থ কোনাে ব্যক্তির রক্ত, শরীর-রস বা মিউকাস আবরণের সংস্পর্শ ঘটে, তবে এইচআইভি তথা এইডস রােগের বিস্তার ঘটে। উল্লিখিত সংস্পর্শ বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে। যেমন: অবাধ যৌন মিলন, এইডস-আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে ধারণ বা গ্রহণ, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার, এমনকী সংক্রমিত মায়ের স্তনপানের মাধ্যমে শিশুর দেহে পর্যন্ত এ রােগ ছড়াতে পারে। এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়তে ৩ থেকে ৬ মাস নেয়। ক্ষেত্র বিশেষে রােগী লক্ষণ প্রকাশ ব্যতীত ১৫ বছর পর্যন্ত বাহক পর্যায়ে থেকে যেতে পারে। বাহকদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগের ক্ষেত্রে ৮ বছর এবং ৫০ ভাগের ক্ষেত্রে ১৫ বছর পর এইডস রােগ বিকশিত হয়।
এইডস-এর বিস্তার: HIV নামক ভাইরাস সর্বপ্রথম আমেরিকায় ধরা পড়লেও রােগটি আফ্রিকা থেকেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এইডস-এর আতঙ্ক বিশ্বব্যাপী। আমেরিকা, ইউরােপ মহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ রােগের বিস্তৃতি ঘটেছে। এইডস-এর বিস্তার ইতােমধ্যে মহামারীতে রূপ নিয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপাের্টে প্রকাশ। বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন দেশ ভারত, মায়ানমার ও নেপালে ইতােমধ্যে এইডস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ২০০২ সালের জরিপ অনুযায়ী এ সকল দেশে সংক্রমণের হার ছিল যথাক্রমে ২.৬৩ শতাংশ, ৩৭.১ শতাংশ এবং ৩৭.৩৮ শতাংশ। উল্লিখিত জরিপে HIV সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
এইডস-এর প্রতিরােধ ও প্রতিকার: বিগত শতাব্দীতে কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্তসহ প্লেগ রােগের ন্যায় আরও বহুবিধ রােগের প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে চিকিৎসা-বিজ্ঞানীগণ। ঘাতক এইডস-এর রােধকল্পে উন্নতদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের চিকিৎসা-বিজ্ঞানীগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এইডস এর প্রতিষেধকও একদিন হয়তাে আবিষ্কৃত হবে। তবে তার পূর্বে এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলে ঘাতক এইডসের ছােবল থেকে মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে, এতে সন্দেহ নেই। যেমন:
- অবাধ যৌনাচারের অপসংস্কৃতি বর্জন।
- নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরােপ।
- মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা।
- যৌনমিলনের ক্ষেত্রে পরীক্ষিত ব্রান্ডের কনডম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
- রক্ত সংগ্রহের পূর্বে রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করা।
- গর্ভাবস্থায় মায়ের এইডস ছিল কি না তা পরীক্ষা করা।
- এইডস-আক্রান্ত রােগীর জীবন বৃত্তান্ত চিকিৎসকের জেনে নেওয়া।
- আক্রান্ত রােগী অন্য কোথাও রক্ত দিয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা।
- সুঁচ, সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা।
- প্রচার মাধ্যমগুলােকে এইডস প্রতিরােধ সংক্রান্ত তথ্য প্রচারে সক্রিয় করা।
উপসংহার: এইডস ঘাতক ব্যাধি হলেও আধুনিক বিশ্বের মানুষ এ ব্যাধিকে রােধ করার জন্যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমেরিকা সহ অন্যান্য উন্নত দেশেও এইডস-এর কালাে থাবা থেকে বেঁচে থাকার জন্যে সাংগঠনিকভাবে জনমত গড়ে উঠছে। এইডস-এর ভাইরাস থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের প্রচার পত্র, বেতার টেলিভিশনের মাধ্যমে এ ঘাতক ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সরকার এইডস প্রতিরােধে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এ কথাই সত্য যে নৈতিক অবক্ষয় রােধ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে মরণ ব্যাধি এইডসের ছােবল থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যাবে। এ ঘাতক ব্যাধির প্রতিষেধক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আবিষ্কৃত হলে এইডস- এর অভিশাপ অন্য পাঁচটি ভাইরাসের ন্যায় বিলীন হয়ে যাবে।