কম্পিউটার প্রজন্ম বিভাগ: কম্পিউটারের পাঁচটি প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য গুলো বর্ণনা
আমাদের আজকের আর্টিকেলটিতে বর্ননা করা হয়েছে কম্পিউটার প্রজন্ম কয়টি ও কি কি এবং কম্পিউটার প্রজন্ম কাকে বলে। কম্পিউটার প্রজন্মের ৫টি প্রকারভেদ এবং কম্পিউটারের পাঁচটি প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য গুলো বর্ণনা। ও প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য, দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য, তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য, চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য, পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য
কম্পিউটারের প্রথম প্রজন্ম হচ্ছে ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করে তৈরি করা যন্ত্রসমূহের যুগ। এ প্রজন্মের কমিপউটারে নানা প্রকার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা ছিল । তবুও এই যন্ত্রগুলােই পরবর্তী প্রজন্মের নতুন দিগন্তের ভিত্তি তৈরি করেছে। সামরিক বাহিনীর সমরকৌশলের প্রয়ােজনীয়তা প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার-প্রযুক্তি বিকাশে ব্যাপক সহায়তা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সংকেতলিপির পাঠোদ্ধারের জন্য ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ULTRA নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ব্রিটিশদের দ্বারা ১৯৭৪ সালে স্বীকৃত এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৪৩ সালে প্রথম কলােসাস নামের একটি কম্পিউটার তৈরি করা হয়।
১৯৪৬ সালে সমাপ্ত এনিয়াক ছিল বহুমুখী কাজের জন্য তৈরি কম্পিউটার । এ দিক থেকে এনিয়াক কম্পিউটার হচ্ছে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বা সফল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার। এনিয়াক (ENIAC) -এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর এন্ড কম্পিউটার (Electronic Numerical Integrator and Computer)। এনিয়াক কম্পিউটারে ১৮০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল । এটি 20x40 ফুট মাপের জায়গা জুড়ে স্থাপন করা হয়েছিল এবং যন্ত্রটির ওজন ছিল ৩০ টন।
এই এনিয়াক কম্পিউটার সেকেন্ডে ৫০০০ যােগ এবং ৩০০ গুণের কাজ করতে পারত। ঐ সময়ের মার্ক-১ এবং অন্যান্য গণনা যন্ত্রের চেয়ে এনিয়াক ৩০০ গুণ বেশি গতিতে কাজ করতে পারত। তবে এনিয়াক কম্পিউটারের অভ্যন্তরে নির্বাহ সংকেত বা পরিচালনা নির্দেশ ধারণ করার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। বাইরে স্থাপিত প্লাগ বাের্ড ও সুইচের সাহায্যে পরিচালনা নির্দেশ বা নির্বাহ সংকেত প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ করতে হত। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কাজে এনিয়াক কম্পিউটার ব্যবহৃত হয়।
১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে খ্যাতনামা গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান (John Von Neumann) এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, কম্পিউটার যন্ত্রের জন্য বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে এবং যন্ত্রের অভ্যন্তরেই উপাত্ত ও নির্বাহ সংকেত মজুদের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এ ধারণা অবশ্য আটানাসফের এবিসি কম্পিউটারেই প্রথম কাজে লাগানাে হয়েছিল। তিনি এ ধারণাটি লিখিত আকারে প্রকাশ করেন। তাঁর এ অভিধারণা সংরক্ষিত প্রােগ্রাম (Stored program) নামে খ্যাত এবং এই সংরক্ষিত প্রােগ্রামের ধারণার ভিত্তিতেই এডভ্যাক (EDVAC: Electronic Discrete Variable Automatic Computer) কম্পিউটার তৈরি করা হয়।
সংরক্ষিত প্রােগ্রামের সুবিধা হল, এতে আগের মতাে প্রত্যেক বার নতুন প্রােগ্রামের শুরুতে অসংখ্য তার (Wire) ও সুইচ বিন্যস্ত করে এবং ব্যবহার করে নির্বাহ সংকেত প্রদানের ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হত না। উপাত্তের মতােই কম্পিউটারের স্মৃতিতে বা মজুদ অংশে (Storage area) নির্বাহ নির্দেশমালা প্রােগ্রাম আকারে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যেত।
১৯৪৬-৫২ সালের মধ্যে মুর স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিজ্ঞানীরা এডভ্যাক কম্পিউটার তৈরি করেন। আমেরিকায় এডভ্যাক কম্পিউটার তৈরির সময়েই ব্রিটেনেও সংরক্ষিত প্রােগ্রামের অভিধারণার ভিত্তিতে আর একটি কম্পিউটার তৈরি হচ্ছিল । ১৯৪৯ সালের মে মাসে প্রথম প্রােগ্রাম নির্বাহের মধ্য দিয়ে এ কম্পিউটারটির ব্যবহার শুরু হয়। এডস্যাক (EDSAC: Electronic Delay Storage Automatic Calculator) নামে পরিচিত এ কম্পিউটার ১৫০০ মাইক্রোসেকেন্ডে যােগ এবং ৪০০০ মাইক্রোসেকেন্ডে গুণের কাজ করতে পারত ! কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গাণিতিক গবেষণাগারে অধ্যাপক মরিস উইলকিস (Prof. Mauric Wilkes)-এর নেতৃত্বাধীন একদল বিজ্ঞানী এডস্যাক কম্পিউটার তৈরি করেন । প্রকৃতপক্ষে এডস্যাক কম্পিউটারকেই প্রথম সংরক্ষিত প্রােগ্রাম বিশিষ্ট ইলেকট্রনিক কম্পিউটার হিসেবে ধরা হয় ।
এডভ্যাক কম্পিউটার তৈরির কাজ বিলম্বিত হওয়ার কারণ ছিল প্রেসপার একার্ট এবং জন মউসলি ১৯৪৬ সালে তাঁদের নিজস্ব একটি কোম্পানি গঠন করেন এবং ইউনিভ্যাক (UNIVAC: Universal Automatic Computer) নামে কম্পিউটার তৈরির কাজ আরম্ভ করেন। ১৯৫১ সালে প্রথম ইউনিভ্যাক-১ (UNIVAC-1) কম্পিউটারটি তৈরি করা হয় এবং সেন্সস ব্যুরােতে স্থাপন করা হয়। সেন্সস ব্যুরাে এ কম্পিউটারটি প্রায় ১২ বছর ব্যবহার করে । ইউনিভ্যাকই ছিল প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার।
ইউনিভ্যাক-১ স্থাপন করার পর সেন্সাস ব্যুরাে আইবিএম-এর পাঞ্চকার্ড যন্ত্রপাতি পরিহার করে । এ পর্যায়ে আইবিএম কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার পুত্র টমাস ওয়াটসন (Tomas Watson) কম্পিউটার ব্যবসায়ের জগতে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন । তিনি ১৯৫২ সালে আইবিএম ৭০১ এবং ১৯৫৩ সালে আইবিএম ৬৫০ কম্পিউটার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি করেন।
আইবিএম ৬৫০ সহস্রাধিক পরিমাণে বিক্রয় হয় । বাণিজ্যিক ভাবে ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরি ও বিক্রয় এ সময় থেকেই উল্লেখযােগ্য ভাবে শুরু হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের জন্য কম্পিউটার ক্রয় করে। যদিও এসব কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বিজ্ঞানের বাইরের জগতের ব্যবহারকারীরা কম্পিউটারকে ব্যবসায়িক হিসেব-নিকেশের যন্ত্র হিসেবে মনে করত। তাদের চাহিদার কথা ভেবেই বেতন বিল তৈরি করার মতাে কিছু কাজের জন্য প্রথম বাণিজ্যিক প্রােগ্রাম প্রণয়ন করা হয়। এনিয়াক থেকে শুরু করে এ যাবৎ আলােচিত প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার গুলােতে ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহারের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হত। আর মেশিনের ভাষায় প্রােগ্রাম রচনা করার কাজও ছিল কষ্টসাধ্য। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া মেশিনের ভাষায় প্রােগ্রাম রচনা করা সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া ভ্যাকুয়াম টিউবগুলাের আয়ু ছিল ক্ষণস্থায়ী।অনবরত টিউব নষ্ট হত এবং সেগুলাে বদল করতে হত।
প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলাে হচ্ছে (Features 1st generation computer):
- ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যবহার
- পাঞ্চকার্ডের সাহায্যে ইনপুট-আউটপুট প্রদান
- চালনার সময় উচ্চ শব্দ হওয়া
- প্রচণ্ড উত্তাপ সৃষ্টি হওয়া
- প্রােগ্রাম রচনায় সংকেতের ব্যবহার করা।
অসংখ্য ডায়ােড ও ট্রায়ােড, ভালভ, রেজিস্টার, ক্যাপাসিটর ইত্যাদি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করার ফলে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার গুলাে বিশাল আকৃতির হত এবং অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের কারণে কম্পিউটার যন্ত্র খুব তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়ে যেত। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পানি ঢেলে উত্তপ্ত যন্ত্র ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করা হত। এ সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ১৯৫৯ সাল থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার তৈরির যাত্রা শুরু হয়।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার (১৯৫৯-৬৫) second generation computer (1959-65)
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারগুলাে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের তুলনায় ছিল অনেক বেশি গতি সম্পন্ন, অনেক বেশি কাজের ক্ষমতা বিশিষ্ট এবং আকারে ছােট। দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের প্রধান পরিবর্তন ও অগ্রগতি হচ্ছে ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টরের ব্যবহার। ট্রানজিস্টর ব্যবহারের ফলে দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের আকার ছােট হয়ে আসে।
আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে ১৯৪৭ সালে জন বারডিন (John Bardeen), উইলিয়াম শকলে (William Shockley) এবং ওয়াল্টার ব্রটেইন (Walter Brattain) ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করেন। ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যবহারে বিদ্যুৎ খরচ পড়ে অনেক কম, যন্ত্রাংশ গরম হয় না, কর্ম-সময় বেড়ে যায় । দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে মডিউলার ডিজাইন ব্যবহার করা হয় এবং সার্কিটের প্রধান প্রধান অংশ ভিন্ন ভিন্ন বাের্ডে স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার থেকেই উচ্চ স্তরের ভাষায় প্রােগ্রাম রচনা ও ব্যবহার শুরু হয়। এ ছাড়া চৌম্বক কোরের ব্যবহারও এ প্রজন্মের কম্পিউটার থেকেই শুরু হয়। এ সময়ের জনপ্রিয় কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে হানিওয়েল-২০০, আইবিএম-১৪০০, ১৬০০, আইবিএম ১৪০১, ১৬২০, সিডিপি ১৬০৪ আরসিএ ৩০১ ও ৫০১, এনসিআর-৩০০ ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারগুলাের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে হচ্ছে (Features 2nd generation computer):
- ট্রানজিস্টরের ব্যবহার।
- ম্যাগনেটিক কোর মেমােরির ব্যবহার।
- ফোরট্রান/কোবল ইত্যাদি প্রােগ্রামিং ভাষার উদ্ভব, বিকাশ ও ব্যাপক ব্যবহার।
- যন্ত্রপাতি ছােট হয়ে আসা
- কম উত্তপ্ত হওয়া।
- কাজের গতি বৃদ্ধি।
- আস্থা ও নির্ভরশীলতা অর্জন।
- আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের ব্যবহার
- সেমিকন্ডাক্টর মেমােরির ব্যবহার
- হাই লেভেল ল্যাংগুয়েজের ব্যবহার
- আউটপুটের জন্য ভিডিও ডিসপ্লে ইউনিট (VDU) এবং লাইন প্রিন্টারের ব্যবহার।
- ভেরি লার্জকেল ইন্টিগ্রেসন বা VLSI চিপের ব্যাপক ব্যবহার ও অভাবনীয় উন্নয়ন ও বিকাশ।
- মাইক্রোপ্রসেসর ও মাইক্রো কম্পিউটারের আবির্ভাব, বিকাশ ও বিশ্বময় প্রসার।
- অতি ক্ষুদ্রাকৃতির বহনযােগ্য যন্ত্র নির্মাণের ব্যবস্থা
- নির্ভরযােগ্য, সম্প্রসারণযােগ্য, মাল্টিমিডিয়া, মাল্টিপ্রসেসিং সমন্বিত সেবা প্রদানকারী মাল্টিমিডিয়া সক্ষম অপারেটিং সিস্টেমের বিকাশ
- অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড প্রােগ্রামিং প্যাকেজ ও কাস্টমাইজ সফটওয়্যারের আনয়ন।
- ডাটা স্টোরেজ ও সহযােগী যন্ত্রের পরিধির ব্যাপক সম্প্রসারণ।
- বহুমুখী কাজে বহুমুখী ইনপুট/আউটপুট যন্ত্রের ব্যবহার।
- মাল্টিপ্রসেসর সিস্টেমের আবির্ভাব।
- উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্রুতগতির হাজার হাজার মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবহার।
- নতুন প্রজন্মের নতুন আকৃতির উচ্চ প্রসেসিং ক্ষমতার একাধিক কোরের মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবহার।
- ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রােগ্রামিং।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রােবােটিক প্রযুক্তির চরম বিকাশ।
- ইনপুট ও আউটপুট যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা বিলােপ
- কণ্ঠস্বর শনাক্তকরণ ও বিশ্বের সকল ভাষায় কম্পিউটিং।
- ডায়নামিক/ইন্টারএকটিভ মাল্টিমিডিয়াসহ সকল ধরনের তথ্য পারাপার, প্রক্রিয়াকরণ ও ধারণ করার বিপুল ক্ষমতা অর্জন।
- ডাটা স্টোরেজ ও সহযােগী যন্ত্রের পরিধির ব্যাপক সম্প্রসারণ।
- বহুমুখী কাজে বহুমুখী ইনপুট/আউটপুট যন্ত্রের ব্যবহার।
- একসাথে অনেক কাজ করা বা মাল্টিপ্রসেসিং ও মাল্টিটাস্কিং সিস্টেমের ব্যাপক ব্যবহার।