ডেটা / ইনফরমেশন ব্রোকার কি? কিভাবে আপনি অজান্তে তাদের পন্য হয়ে যাচ্ছেন!
বর্তমান সময়ে অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। অর্থ উপার্জনের পন্থা গুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের এবং বৈচিত্র্যময়! কেউবা অর্থ উপার্জনের জন্য চাকরি করছে কেউবা ব্যবসা। কেউবা দিনমজুর! তবে সবার লক্ষ্য একটাই অর্থ উপার্জন করা।
Information brokers |
ডেটা ব্রোকার বা তথ্যের দালাল কি? আমরা সকলেই জানি, "ডেটা এর বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে তথ্য" এবং "ব্রোকার শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দালাল"। তাহলে সহজ ভাবে বলতে গেলে তথ্য নিয়ে যারা দালালি বা ব্যবসা করছে তাদেরকে আমরা ডেটা ব্রকার (data broker) বলতে পারি!
তাহলে কারা এই ডেটা ব্রোকার (data broker) বা তথ্যের দালাল! পৃথিবীতে যত গুলো পেশা রয়েছে তার জন্য নিশ্চয়ই আমাদের বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে হয়। যেমন ধরুন একজন ডাক্তার নিজেকে ডাক্তার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার ডাক্তারি পড়তে হয়। একজন উকিল কে এলএলবি (LLB) পড়ার মাধ্যমে ওকালতি শিখতে হয়। একজন ইঞ্জিনিয়ার কে ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন করার মাধ্যমে নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হয়।
এই প্রত্যেকটি পেশায় নিজেকে গড়ে তুলতে এবং অধ্যায়ন করতে রয়েছে বিভিন্ন ইনস্টিটিউট। তবে ডেটা ব্রোকার এর ক্ষেত্রে কোন লেখাপড়া বা ইনস্টিটিউট এর নাম কেউ এখন পর্যন্ত শোনেননি! তাহলে কে এই ডেটা ব্রোকার বা কিভাবে এটি তৈরি হয়। এবং তারা এই তথ্য গুলো সংগ্রহ করে কিভাবে।
আমরা দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকি যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে একটি মানুষ প্রতিদিন গড়ে আড়াই ঘণ্টার সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যায় করে থাকে। এবং বাংলাদেশে প্রতি ১২ সেকেন্ড এ একজন নতুন ফেসবুক ব্যাবহারকারী বৃদ্ধি পায়! যা আমাদের দেশের জন্মহারের চেয়ে বেশি!
এই কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মানুষ বর্তমান সময়ে ফেসবুক নামক সোশ্যাল মিডিয়া সর্বাধিক সময় ব্যয় করে থাকে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার গুলোতে বিভিন্ন ধরনের তথ্য যেমন আমাদের ছবি, আমাদের পরিচয়, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার, পছন্দ-অপছন্দ সহ আরো কত কিছু শেয়ার করে থাকি।
কার জন্মদিন কবে? বর্তমানে ফেসবুক নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আমরা আমাদের বন্ধু বান্ধবের জন্মদিনের সময় জানতে পারি! কারন ফেসবুক একাউন্ট খোলার সময় জন্মতারিখ সেট করতে হয়। চ্যাটিং এর মাধ্যমে আমরা বন্ধুবান্ধবের সাথে বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা করে থাকি এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও অবগত করে থাকি। এবং কারণে অকারণে আমরা দিনের বেশিরভাগ সময়ে ফেসবুক নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় টাইমলাইন বা নিউজ ফিড স্ক্রোল করতে থাকি। কেউ কোন ছবি আপলোড দিলে তাতে আমরা বিভিন্ন ধরনের রিয়্যাক্ট দেই! আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে আমরা এই সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমাদের যাবতীয় তথ্য এই সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে আমরা সবাই স্ব-ইচ্ছায় প্রদান করে থাকি!
আচ্ছা ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য কি আপনার কোন অর্থ প্রদান করতে হয় তাদের? না ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের জন্য আমাদের কোনো অর্থ প্রদান করতে হয় না। শুধুমাত্র মোবাইল ডাটা এবং একটি মোবাইল হলেই আমরা এসকল সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারি।
তাহলে এখানে যেহেতু আমাদের কোনো অর্থ প্রদান করতে হয় না তাহলে তারা আমাদের বিনামূল্যে এই পরিষেবা কেন দিচ্ছে? নিশ্চয়ই ভাববার একটি বিষয়। কারণ বিনা লাভে কেউ তো আপনাকে কোন সুযোগ দিবে না। সেখানে ফেসবুক ব্যবহারের মত এমন সুযোগ বিনামূল্যে পাচ্ছি ভাবা তো বোকামি!
তাহলে ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা কোন অর্থপ্রদান ছাড়াই ব্যবহার করতে পারছি কিসের বিনিময়ে? ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার জন্য আমরা তাদের হাতে আমাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে দিচ্ছি। আর এটাই হচ্ছে আপনি যে ফেসবুক ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন তার বিনিময়!
আপনি এই ফেসবুক ব্যবহারের যে সুবিধা পাচ্ছেন তার বিনিময় আপনাকে অর্থের পরিবর্তে তথ্য প্রদান করতে হচ্ছে। এবং সেই তথ্যগুলো আপনি আপনার নিজের অজান্তেই তাদের দিয়ে দিচ্ছেন। আর তারা আপনার এই তথ্যের মাধ্যমে আয় করে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি কোটি ডলার।
আপনি ভাবতে পারেন আপনার কি এমন তথ্য আছে যার মাধ্যমে তারা এত হাজার হাজার ডলার আয় করতে পারে! আপনি হয়তো জানেন না বর্তমান সময়ে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হচ্ছে তথ্য। যার কাছে বেশি তথ্য থাকবে সে ততো বেশি শক্তিশালী। আর আপনার এই তথ্য নিয়ে ফেসবুকে ব্যবসা করছে এটাকেই বলা হয় ডেটা ব্রকার (data broker) বা তথ্য নিয়ে ব্যবসা।
সমস্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য ফেসবুকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে যা তারা কোটি কোটি ডলারের বিনিময় বিভিন্ন সংস্থার নিকট বিক্রি করে থাকে।
এবার প্রশ্ন আসতে পারে এই তথ্য নিয়ে তারা কি করে! কেনইবা ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য নিতে ফেসবুক কে এত টাকা দিবে কোন কোম্পানি। ফেসবুক মূলত এমন ভাবে তৈরি যেখানে আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিলেও আপনার অনিচ্ছা আসবেনা। ধরুন এই ঘন্টা খানেক ফেসবুক ব্যবহার করে ফেসবুক থেকে বের হলেন আবার আপনি ফেসবুকে প্রবেশ করলেন এটাই হচ্ছে বর্তমান সমাজের চিত্র।
ফেসবুক ব্যবহারের সময় আপনি যে সকল কাজগুলো করছেন সেগুলোর মধ্য থেকে ফেসবুকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বট (artificial intelligence bot) আপনার তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং আপনার নামে আলাদা আলাদা প্রোফাইল তৈরি করে আপনার তথ্য গুলো সেভ করছে।
ফেসবুকের এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বট (artificial intelligence bot) আপনার বয়স, পছন্দ-অপছন্দ, আপনি কোন ধরনের খাবার খেতে ভালোবাসেন, আপনার কি দরকার বা খুঁজছেন, আপনি কোন জিনিসগুলো পছন্দ করেন ইত্যাদি ইত্যাদি সাজিয়ে একটি প্রোফাইল তৈরি করে। অর্থাৎ আপনি যতটুকু সময় ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করছেন সকল সময় আপনাকে এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বট ফলো করছে এবং আপনার তথ্য গুলো সংগ্রহ করছে।
ধরুন আপনি আপনার কোনো বন্ধুর কাছে বার্তা দিলেন যে আপনি একটি গাড়ি কিনতে চান বা আপনার ব্যাংক লোন দরকার। দেখবেন তার কিছু সময় পরেই আপনার টাইমলাইন জুড়ে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন বা যেসকল ব্যাংক লোন দিয়ে থাকেন তাদের বিজ্ঞাপন চলে আসছে।
তাহলে আপনার সামনে এই গাড়ির বিজ্ঞাপন বা ব্যাংক লোন এর বিজ্ঞাপন কিভাবে আসলো ফেসবুক কিভাবে জানল আপনার গাড়ি কেনা দরকার। ফেসবুক জানতে পারছে আপনারা বন্ধুকে পাঠানোর সেই বার্তার মাধ্যমে। সেখান থেকেই ফেসবুকের ইন্টেলিজেন্স বট জানতে পেরেছে আপনার একটি গাড়ি কেনার ইচ্ছা এবং সেভাবেই বিজ্ঞাপনগুলো অপটিমাইজ হয়ে আপনার সামনে আসা শুরু করেছেন।
এর পরে দেখা গেল আপনি গুগলে কোন বিষয় সার্চ করে কোন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেছেন। সেখানেও বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ির বিজ্ঞাপন আপনার সামনে আসা শুরু করলো। আপনি হয়তো সচারাচর বিষয় গুলো পাত্তা দেন না বা এভাবে গভীরভাবে হিসাব করে দেখেন না তবে সেই ফেসবুক এর মেসেজের মাধ্যমেই সব ঘটেছে!
কিন্তু এখানে আরেকটি প্রশ্ন থেকেই যায় আপনি মেসেজ দিয়েছিলেন ফেসবুকে তাহলে গুগোল কি করে জানবে যে আপনার গাড়ি কেনা দরকার? এর একটাই কারণ হচ্ছে গুগল কোম্পানি ফেসবুকের কাছ থেকে আপনার তথ্যগুলো কিনে নিয়েছে এবং সে জানতে পেরেছে যে আপনার একটি গাড়ি কেনা দরকার। আর সেভাবেই গুগল আপনাকে বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে ডেটা ব্রকার বা তথ্যের ব্যবসা বাজার অন্য সকল বিজনেস প্লাটফর্ম হতে বড়। কারণ এসকল তথ্য ব্যবহার করে আপনার প্রয়োজন তারা বুঝতে পারে বা আপনার বিষয়ে জানতে পারে।
সারা পৃথিবীর মানুষের বর্তমানে মানুষের সবচেয়ে বেশি তথ্য রয়েছে ফেসবুক এবং গুগলের নিকট। এবং বর্তমানে ফেসবুক এবং গুগোল আপনার সম্পর্কে যে সকল তথ্য জানেন সেগুলো আপনি আপনার সম্পর্কে নিজেও জানেন না।
তবে আমরা জানি কারো বিনা অনুমতিতে তাদের নিকট হতে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা আইনত দণ্ডনীয় তাহলে কিভাবে এরকম কোম্পানি আপনার তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। একটি দেশের আদালত বা বিচারব্যবস্থা কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না!
এর একটাই কারন আপনি যখন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন তখন আপনার নাম ঠিকানা মোবাইল নম্বরের দেওয়ার সাথে সাথে আরেকটি কাজ করতে হয়েছিল! বলুনতো নাম-ঠিকানার পাশাপাশি আপনি আর কোন কাজটি করেছিলেন? ভেবে পাচ্ছেন না তাহলে আমি বলে দিই!
আপনি যখন ফেসবুক একাউন্টটা খুলেছিলাম তখন তাদের একাউন্ট খোলার ফরম টি পূরণের পাশাপাশি সাইন আপ করার পূর্বে I agree to terms and condition লেখা একটি ঘরে টিক চিহ্ন দিয়ে ছিলেন। এখানে একটি টার্মস এন্ড কন্ডিশনের বিশাল একটি আর্টিকেল ছিল। যা আপনি পড়ে দেখেন নি ওখানে কি লেখা আছে এবং টিক দিতে হবে জেনে টিক দিয়ে দিয়েছিলেন।
সেখানে ফেসবুক আপনার কোন কোন তথ্য সংগ্রহ করবে এবং তাদের কাজে ব্যবহার করবে ইত্যাদি সকল বিষয়ে আপনাকে অবগত করেছে কিন্তু আপনি তা খেয়াল করে দেখেন নি বা পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন নাই।