সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সেরা ৪ উপন্যাস
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সেরা ৪ উপন্যাস
বাংলা সাহিত্য যখন প্রায় ধ্বংসের পথে, অস্তিত্ব যখন প্রায় বিলীন হতে বসেছিল তখন ই আগমন ঘটে বাংলার সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। তার রচিত "দূর্গেশনন্দিনী" বাংলার সাহিত্য সম্ভারে এক অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যার রেশ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। অনেকেই তাকে বলেছেন সাহিত্য সম্রাট আবার অনেকেই তার দিকে তুলেছেন সাম্প্রদায়িকতার আঙ্গুল। যে যাই বলুক না কেন, কবিগুরু কিন্তু তাকে সাহিত্যের "সব্যসাচী" আখ্যা দিয়েছেন। কেননা রোমান্টিকতা, ট্রাজেডি সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। বাংলার সব্যসাচীর সেরা ৪ উপন্যাস নিয়ে সাজিয়েছি আমাদের আজকের আয়োজন।
১.দূর্গেশনন্দিনী:
দূর্গেশনন্দিনী বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয় বাংলা ১৮৬৫ সালে। উপন্যাসটির প্রধান দুই চরিত্র হল জগৎসিংহ এবং তিলোত্তমা। উপন্যাস এ দেখা যায় দিল্লীশ্বরের সেনাপতি 'মানসিংহের' পুত্র "জগৎসিংহ" বিষ্ণুপুর থেকে যাত্রা করার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে। ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি যাত্রা পথের কাছে অবস্থিত মহাদেবের মন্দিরে আশ্রয় গ্রহন করেন। ঘটনাচক্রে ওই মন্দিরে ওই সময় আমাদের উপন্যাসের নায়িকা দূর্গেশনন্দিনী "তিলোত্তমা" এবং তার মাতা বিমলা অবস্থান করছিলেন। তিলোত্তমা হলেন মহারাজ বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা। একই মন্দিরে অবস্থান করলেও তারা উভয়ে উভয়ের নিকট তাদের পরিচয় গোপন রাখেন।
তারা উভয়ে উভয়ের কাছে পরিচয় গোপন রেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু প্রকৃতির প্রাচীন খেলায় তারা পরস্পর পরস্পরের প্রেমে পড়েন। উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র হল পাঠান সেনাপতি ওসমান খাঁ। মহারাজ বীরেন্দ্রের রাজ্য 'মান্দারনের' প্রতি তার অনেক দিনের লিপ্সার ফলশ্রুতিতে তিনি মান্দারন দুর্গ আক্রমন করেন এবং রাজা বীরেন্দ্র সিংহ, রানী বিমলা এবং রাজকন্যা তিলোত্তমা কে বন্দী করেন। ঘটনাচক্রে ওই একই সময়ে কুমার জগৎসিংহ ও ওসমান খাঁ র হাতে বন্দী হন। এরপর চলে নানা সংঘাত। সমস্ত সংঘাত পার করে অবশেষে কুমার জগৎসিংহ এবং দূর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমার প্রেম পূর্নতা লাভ করে।
২.বিষবৃক্ষ:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'বিষবৃক্ষ' একটি ত্রিভুজ প্রেমের উপন্যাস। বিষবৃক্ষ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে। এই উপন্যাসে রোমান্টিসিজমের পাশাপাশি ট্রাজেডির একটি প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই উপন্যাসটির প্রধান বিষয় বস্তু হল বহুবিবাহ এবং বিধবা বিবাহ। গল্পের প্রধান তিন চরিত্র হল নগেন্দ্র, তার স্ত্রী সূর্যমুখী এবং কুন্দননন্দিনী।
উপন্যাসে দেখা যায় নগেন্দ্র কলকাতা থেকে আসার পথে কুন্দননন্দিনী নামক এক বালিকার সন্ধান পান। কুন্দননন্দিনী বালিকা , তার উপর অনাথ এটা জানতে পেরে নগেন্দ্র কুন্দকে সাথে করে নিয়ে আসে এবং তার ভগিনী কমলমনির কাছে রাখে। সূর্যমুখীএটা জানতে পেরে কুন্দকে কমলের কাছ থেকে নিয়ে আসে এবং তার ভাই তারাচরনের সাথে কুন্দের বিয়ে দেয়। কিন্তু নিয়তির নির্মমতায় বিয়ের অল্পকিছুদিনের মধ্যে কুন্দননন্দিনী বিধবা হয়। এদিকে দেবীপুরের জমিদার দেবেন্দ্র বিধবা কুন্দের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে নগেন্দ্র ও বিধবা এবং অল্পবয়সী, সুন্দরী কুন্দের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বয়সের বিড়ম্বনায় কুন্দননন্দিনী ও একসময় নগেন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
এদিকে দেবেন্দ্র এক বৈষ্ণবীর বেশ ধারন করে কুন্দের সাথে দেখা করতে আসত। নকল বৈষ্ণবী র বিষয়টি সূর্যমুখী জানতে পারে এবং কুন্দননন্দিনী কে তিরস্কার করে। এতে অপমানিতা কুন্দননন্দিনী গৃহত্যাগ করলে নগেন্দ্র কুন্দননন্দিনীর জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। সূর্যমুখী বুঝতে পারে নগেন্দ্রের জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা শেষ। সূর্যমুখী নগেন্দ্রের সাথে কুন্দের বিয়ে দেয় এবং নিজে গৃহত্যাগ করেন। সূর্যমুখীর গৃহত্যাগের পর নগেন্দ্র সূর্যমুখীর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে এবং তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। সূর্যমুখী ফিরে আসে ঠিক ই কিন্তু এই নির্মম পৃথিবীর সব স্থানে অবহেলিত কুন্দ বিষ পানে আত্মহত্যা করে।
৩.কৃষ্ণকান্তের উইল:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত কৃষ্ণকান্তের উইল একটি সামাজিক উপন্যাস। কৃষ্ণকান্তের উইল প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে।এটিও একটি ত্রিভুজ প্রেমের উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রধান তিন চরিত্র হল গোবিন্দলাল, ভ্রমর এবং রোহিনী।
উপন্যাসে দেখা যায় কাহিনীর নায়ক জমিদার গোবিন্দলাল একজন সুদর্শন যুবা এবং তার স্ত্রী ভ্রমর। কাহিনী অপর চরিত্র রোহিনী ঐ জমিদার বাড়ির একজন দাসি। কিন্তু দাসী হলেও রোহিনী ছিল দুশ্চরিত্রা। কাহিনীর এক পর্যায়ে গোবিন্দলাল এবং রোহিনী পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং এক পাপের জগতে পর্যবেশিত হয়। ভ্রমরের শত বাধা এবং অঢেল প্রেম ও গোবিন্দলাল কে এই পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। একদিকে গোবিন্দলাল পরাজিত হয় নারী লোভ , মদ্যপান এবং জুয়ার কাছে এবং অন্যদিকে আত্মহত্যা করেও ভ্রমর বিজয়ী হয় স্বর্নপ্রতিমা রুপে।
৪.কমলাকান্তের দপ্তর:
১৪ প্রবন্ধ নিয়ে সাজানো কমলাকান্তের দপ্তর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি রচনা। কমলাকান্তের দপ্তর প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে। লেখক বঙ্কিমের দার্শনিক, ভাবুক, সমাজবিদ, স্বদেশেপ্রমী, হাস্যরসিক চরিত্রের প্রকাশ পেয়েছে এই কমলাকান্ত চরিত্রের মাধ্যমে।
কমলাকান্তের দপ্তর প্রবন্ধটিতে মোট ১৪টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধ গুলো হল:
একা-কে গায় ঐ
মনুষ্যফল
ইউটিলিটি বা উদরদর্শন
পতঙ্গ
আমার মন
চন্দ্রালোকিত
বসন্তের কোকিল
স্ত্রীলোকের রূপ
ফুলের বিবাহ
বড়বাজার
আমার দুর্গোত্সব
একটি গীত
বিড়াল
মশক
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যের একটি অমূল্য রত্ন। উনার বিচার কিংবা উনার তৈরি রচনার বিচার করার সেই সামর্থ্য বা স্পর্ধা কোনোটাই আমাদের নেই। এখানে উল্লিখিত রচনাগুলো পাঠকদের পছন্দের উপর নির্ভর করেই সাজানো হয়েছে।