বাঙালির ভালোবাসার বসন্ত বরন উৎসব নিয়ে বিস্তারিত কিছু লেখা

 বসন্ত বরন: বাঙালির প্রেমের উৎসব 

"ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত 

আজ রিক্ত হস্তে হয়েছি তোমার দারস্থ

আজ বসন্ত "


শেষ হচ্ছে শীতের প্রতাপ। প্রকৃতি যখন আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে  তার দখিন দুয়ার, কালো কোকিল যখন শোনায় তার মধুর অমৃত বাণী,অশোক-পলাশের ডালে লাগে রঙের উচ্ছাস,রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়ার ডালে কালো ভ্রমর বসে তখনই প্রকাশ ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের।  ফাল্গুন মাসের প্রথম দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্তের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও সেজে ওঠে তার আপন রঙে। প্রকৃতি যেন তার শীতের বিরহ বেশ ছেড়ে প্রেয়সি রূপ ধারন করে।

বসন্ত উৎসব নিয়ে লেখা

আমাদের দেশে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩তারিখে পালিত হয় পহেলা ফাল্গুন।  উৎসব পাগল বাঙালির কাছে পহেলা বৈশাখের পর এটি অন্যতম বড় উৎসব। প্রকৃতির সাথে সারা বাঙলা ও যেন উৎসবের রঙে সেজে ওঠে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম , ত্রিপুরা সহ বেশ কয়েকটি বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যে পালিত হয় এই উৎসব।  

কিন্তু কিভাবে এল এই বসন্ত তথা রঙের উৎসব?সেই বৃত্তান্তই জানব আজ। 



দোলউৎসব বা হোলি:

বাঙালির রঙের উৎসবের আগমন মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দোলযাত্রার থেকেই এসেছে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা বা হোলি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধারানীর মধ্যকার রঙ খেলাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই অনুষ্ঠানের প্রচলন ঘটে। এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধারানীকে দোলায় বসিয়ে দোল দেওয়া হয় এবং রঙ মাখানো হয়। ভারতে যেটি হোলি বলে পরিচিত,এপার বাঙলায় সেটি দোল উৎসব নামে পরিচিতি লাভ করে। 


প্রাচীন বাঙলায় এই উৎসবের আগমন ঘটে প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরে। যীশু খ্রিষ্টের ও জন্মের বহু আগে থেকেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের একটি পাথরের উপর ও এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায়। এছাড়া ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান গ্রন্থ বেদে ও এর উল্লেখ রয়েছে।  এছাড়া ও সপ্তম ও অষ্টম শতকে রচিত দুই বিখ্যাত নাটক, "রত্নাবলী " এবং "মালতি-মাধব" এ ও এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া ও জীমূতবাহনের "কালবিবেক" এবং ষোড়শ শতকের রচিত গ্রন্থ "রঘুনন্দন" এ দোলের উল্লেখ রয়েছে। 



বাংলায় বসন্তের আগমন:

দোলযাত্রা বা হোলি মূলত পালিত হত ভারতের পুরীতে। পুরীর অনুকরণে একসময় বাঙলায় ও এই উৎসবের প্রবর্তন ঘটে। দোলযাত্রাকে কেন্দ্র করে বাঙলার মধ্যযুগে রাসমেলা বা রাসযাত্রার প্রচলন ঘটে(এটি নবদ্বীপে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্য বিখ্যাত)। এখন ও বাঙলার খুলনা সহ আরো বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবের প্রচলন আছে। 


বাংলায় বসন্তের আগমন নিয়ে আরেকটি তথ্য প্রচলিত আছে। ১৫৮৫ সনে তৎকালীন বাঙলার সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। যদি আকবরী সন বা ফসলি সন নামে পরিচিত। বর্ষপঞ্জির সাথে তিনি ১৪টি উৎসবের ও প্রচলন করেন। এই ১৪টি উৎসবের মধ্যে অন্যতম ছিল এই বসন্ত উৎসব বা দোলউৎসব।  



পাকিস্তান আমলে বসন্ত উৎসব: 

১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারিতে এক পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে একঝাঁক তরুণের উচ্ছাস,সাহস আর রক্ত যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। পাকিস্তানী শাসকরা শুধু আমাদের ভাষাই নয়,আমাদের শিল্প সংস্কৃতি সবকিছুর উপরে থাবা বসাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের তরুণরা তা কখনোই মেনে নেয় নি। তাই তারা নিজেদের বিলুপ্ত প্রায় সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য সব রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে। পাকিস্তানীদের প্রতি প্রতিবাদ স্বরূপ এদেশের মেয়েরা ষাটের দশক থেকেই  পহেলা ফাল্গুন এ হলুদ শাড়ি পড়া শুরু করে। এখনকার মতো তখনকার দিনে এত রকম ধরনের এবং ডিজাইনের শাড়ি পাওয়া যেতনা। যারা বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি কিনতে পারত না তারা রাত জেগে শাড়ি র উপর বিভিন্ন রকমের নকশা নিজেরাই একে নিত। আর যারা এত কষ্ট করতে চাইত না তারা অন্তত একরঙা হলুদ শাড়ি পরিধান করত। 



ভালোবাসার উৎসব বসন্ত উৎসব: 

"মধুর বসন্ত এসেছে,মধুর মিলন ঘটাতে আমাদের

মধুর বসন্ত এসেছে "


বসন্ত ঋতু হচ্ছে প্রেমের ঋতু। এই ঋতুর আগমনের সাথে সাথে প্রেমিক প্রেমিকাদের মনে যেন অন্যরকম এক অনুভূতির তৈরি হয়। অনেকেই সারা বছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। অনেকেই থাকে যারা নিজেদের মনের কথাটি বলার জন্য এই দিনটিকে বেছে নেয়। প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনে ও লাগে যেন রঙের ছোঁয়া। বিনোদন কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস,সবর্ত্রই লাগে যেন প্রেমের ছোঁয়া।  মানব মানবীর মধ্যকার প্রেমের সম্পর্ককে যদি মহিমান্বিত করতেই হয় তবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতেই হোক,এটিই আমাদের একমাত্র চাওয়া। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url